Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সরকারের দেওয়া সময়সীমা ৩ দিন বাকি

দলগুলোর সমঝোতায় অগ্রগতি নেই

মনির হোসেন

মনির হোসেন

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দলগুলোর সমঝোতায় অগ্রগতি নেই

সরকারের দেওয়া সাত দিনের সময়সীমার মধ্যে চার দিন পার হয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। উলটো বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধ বাড়ছে। দল দুটি এখন মুখোমুখি।

সনদ বাস্তবায়নে গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ জমা দেওয়ার পরপরই এ অবস্থা তৈরি হয়। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুই দলই গণভোটের পক্ষে। কিন্তু বিএনপি চায় জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একইদিনে গণভোট। এছাড়া সনদের যে বিষয়ে তারা নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়েছে, সেগুলো গণভোটের প্রস্তাবে উল্লেখ থাকতে হবে। এ অবস্থায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আলোচনা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে সোমবার ২৩৭টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি।

অন্যদিকে জামায়াত চায় জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট। আর গণভোটের প্রস্তাবে কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকতে পারবে না। এই দাবি বাস্তবায়নে আজ শুক্রবার পর্যন্ত সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে জামায়াতের নেতৃত্বে ৮টি ইসলামি দল। বৃহস্পতিবার তারা প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

এতে বলা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে আগামী ১১ আগস্ট মঙ্গলবার ঢাকায় জনস্রোত নামবে। এদিকে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ ৯টি দল। কিন্তু এ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। তবে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে সরকারকে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিবিদরা দেশকে ভয়াবহ বিপদে ফেলছে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মাহবুব উল্লাহ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষুদ্র ইস্যু সমস্যা তৈরি করছে। তাদের আচরণে দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। এদিকে কারও নজর নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। কারণ দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পুলিশ বাহিনী সমস্যায় রয়েছে।

আইজিপি নিজেই বলেছেন, পুলিশ ঠিকমতো কাজ করছে না বা করতে পারছে না। তৃতীয়ত, পত্রিকায় দেখলাম নির্বাচনের জন্য ডিসি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চতুর্থ বিষয় হলো, আইন আদালতের অবস্থা খারাপ। পঞ্চম বিষয় হলো, শেখ হাসিনা বিদেশে বসে তার দলবল নিয়ে বাংলাদেশের ওপর নানাভাবে আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতীয় নিরাপত্তা নানাভাবে হুমকিতে রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এদিকে গুরুত্ব না দিয়ে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত। তার মতে, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বড় নেতৃত্ব সংকট। এই সংকট উত্তরণে কেউ এগিয়ে আসছে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, অনানুষ্ঠানিক কিছু আলোচনা হচ্ছে। এর আগে আলোচনার জন্য সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় এখনো আছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে সরকার নিজেই একটা ডিসিশন নেবে। আর কী ডিসিশন হবে, সে বিষয়ও এখন প্রস্তুতিমূলক অনেক মিটিং হচ্ছে। তবে আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই পুরো বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসবে।

প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ স্বাক্ষর করেছে। এরপর ২৮ অক্টোবর সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকার একটি আদেশ জারি করবে। কিন্তু আদেশ জারির আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় সমঝোতার জন্য রোববার বিএনপিকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানায় জামায়াতে ইসলামী। পরদিন প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক থেকেও রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার আহ্বান করা হয়।

এজন্য এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ অক্টোবর সোমবার সময়সীমা শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যে দলগুলো সমঝোতায় আসতে না পারলে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। ওইদিন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ঐকমত্য কমিশনে দীর্ঘদিন আলোচনার পরও কয়েকটি সংস্কারের সুপারিশ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। এছাড়া গণভোটের সময় এবং বিষয়বস্তু কী হবে এসব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

এটি উদ্বেগজনক। এ অবস্থায় গণভোটের সময়, বিষয়বস্তু এবং সনদে উল্লেখিত ভিন্নমতের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো স্বীয় উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে সরকার দিকনির্দেশনা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সম্ভব হলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এই পরামর্শ দিতে হবে। এতে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হবে।

বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা : সমঝোতার জন্য সরকারের আহ্বানের দিনেই অর্থাৎ গত সোমবার আগামী নির্বাচনের জন্য ২৩৭ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। এরপর প্রার্থীরা গণসংযোগে মাঠে নেমে যায়। বৃহস্পতিবার যশোরের অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট হতে হবে। এ বিষয়ে আমরা একমত। সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো গণভোট হতে দেওয়া হবে না।’

তিনি বলেন, ‘কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা জনগণ মেনে নেবে না। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি ফ্যাসিস্টের হাত থেকে। একটা সুযোগ পেয়েছি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার। কোনো মহলের চক্রান্তে আমরা এই সুযোগ বিনষ্ট হতে দিতে পারি না।’

রাজনৈতিক দলগুলোকে হুঁশিয়ারি দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা অনেক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছি। আমরা এখনো কোনো বিষয়ে রাস্তায় নামিনি। দয়া করে পানি ঘোলা করবেন না।

আট ইসলামি দলের আলটিমেটাম : জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ৮টি ইসলামি দল জোরালোভাবে মাঠে নেমেছে। বৃহস্পতিবার তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। তারা বলছে-আজ শুক্রবারের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি এবং অবিলম্বে গণভোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে আগামী ১১ অক্টোবর মঙ্গলবার ঢাকায় জনস্রোতের হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

অন্য দলগুলো হলো-ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। দলগুলোর নেতারা বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তির দাবিতে পুরো জাতি এখন ঐক্যবদ্ধ। আর সংস্কার না করে দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তারা বলেন, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব ছিল তিনটি। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন। শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

এনসিপির উদ্যোগ : জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছে ৯টি দল। এর মধ্যে রয়েছে এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি এবং গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত ছয়টি দল। বুধবার রাজধানীর পল্টনে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কার্যালয়ে এই ৯ দলের জরুরি সভায় নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক জোটের সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা হয়। তবে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি দলগুলো। সভার পর ৯ দলের নেতারা জানান, জুলাই সনদ নিয়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তারা বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের পর বিভাজনের রাজনীতি লক্ষ করছি। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয় কিনা সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন।

সরকারের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত : ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রাথমিক একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে সরকার। সেক্ষেত্রে দলগুলোর দাবির মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একইদিনে হবে। এই গণভোটে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলোর ওপর বিভিন্ন দলের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) উল্লেখ থাকবে না। তবে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নে ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটিও তুলে দেওয়া হবে। এছাড়া পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে গঠিত হবে সংসদের উচ্চকক্ষ। অর্থাৎ জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত উভয় পক্ষের যে দাবি রয়েছে, সেসব দাবি মানার ক্ষেত্রে সরকার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।

জানা গেছে, রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই সনদে মোট ৮৪টি প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। সংবিধান সংশোধনে রয়েছে ৪৮টি প্রস্তাব। এ পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াতসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এরপর গত ২৮ অক্টোবর সনদ বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশ অনুসারে প্রস্তাবগুলো তিন ভাগে বাস্তবায়ন হবে। ৯টি নির্বাহী আদেশে, ২৭টি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এবং সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাব গণভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। এছাড়া পরবর্তী সংসদ দুটি দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমত, সংবিধান সংস্কার পরিষদ, দ্বিতীয়ত, নিয়মিত আইনসভা। সুপারিশে আরও বলা হয়, আগামী সংসদে নির্বাচিত সদস্যরা প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই অনুসারে সংবিধান সংশোধন করবেন। এই সময়ের মধ্যে তারা সংবিধান সংশোধনে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে। সুপারিশে আরও বলা হয়, সনদ বাস্তবায়নে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে সরকার একটি আদেশ জারি করবে। আদেশের নাম হবে : ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫।’ এই আদেশের ওপর হবে গণভোট।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম