নির্বাচনের প্রভাবে দুই ঝুঁকি শনাক্ত
রাজনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন: নানা শঙ্কায় ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে মন্থর অবস্থা * সংকট বাড়লে বাড়তি জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আগামীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে ও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে দুটি ঝুঁকি শনাক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে-আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট এবং এর প্রভাব হিসাবে বাড়তে পারে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। আর সত্যিই যদি এ ধরনের পরিস্থিতি সামনে আসে, তাহলে বাড়তি জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে চলমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া এরকম শঙ্কায় ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা মন্থর অবস্থা দেখা দিয়েছে।
এদিকে পণ্যমূল্য, জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস ও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকায় মূল্যস্ফীতির হার আরও নিম্নমুখী হচ্ছে। এতে আগামীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার কমাতে পারে। ফলে বাজারে ঋণের সুদের হার কমবে। এতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পথে সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে।
রোববার প্রকাশিত দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতি তিন মাস পর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে গত জুন পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত নানা পদক্ষেপের ফলে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও বাড়তে শুরু করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা চড়া মূল্যস্ফীতির হার কমছে। ডলারের বিপরীতে বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি সামনে এগিয়ে যাওয়ারই কথা। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পালে আরও জোরে হাওয়া লাগার কথা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করেছে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। এ দু’টি কারণে আগামীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কিছুটা স্তিমিত করে দিতে পারে। এতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা মন্থরতা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরের মাঝামাঝি দুই প্রান্তিকের তুলনায় শেষ প্রান্তিকে কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই সেপ্টেম্বর প্রবৃদ্ধির হার ছিল একেবারে নিম্নে, অর্থাৎ ৩ শতাংশের ঘরে। অক্টোবর ডিসেম্বরে তা কিছুটা বেড়ে ৪ শতাংশের ঘরে উঠে আসে। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির গতি আরও বেড়ে প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। গত এপ্রিল জুন প্রান্তিকে তা আবার কমে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে যায়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার কারণে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। সেবা ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ার কারণে এই মন্থরতা দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তেজনাকর হয়ে উঠছে। সংকটের সমাধান না হলে উত্তপ্ত পরিস্থিতি রাজপথে গড়াতে পারে বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আর রাজনীতির কারণে রাজপথ উত্তপ্ত হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পর্কিত। কারণ নানা খাতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং রপ্তানির কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। পাশাপাশি বৈদেশিক খাতে ভারসাম্য রক্ষায় রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা পালন করে। এ কারণে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উত্তেজনা তৈরি হলে এ দুটি খাতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে বা বাধাগ্রস্ত হয়ে যেমন মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তেমনি রেমিট্যান্স বাধাগ্রস্ত হয়ে ডলার বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। এসব কারণে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত বাড়তি শুল্ক দেশটির বাজারে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির সুযোগ তৈরি করেছে। কারণ প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শুল্ক কিছু ক্ষেত্রে কম, আবার কিছু ক্ষেত্রে সমপর্যায়ে রয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের জন্য এ সুযোগ বাড়তে পারে। কারণ বাংলাদেশ নিম্নমূল্যের পোশাক রপ্তানি করে, যা এখন প্রতিযোগিতামূলকভাবে সুযোগ তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চড়া মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘ সময় ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এতে ঋণের সুদের হার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের নেওয়া বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে এখন মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে বাজারে পণ্যমূল্য আরও কমছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি উপকরণের দামও কমেছে। ফলে আগামীতে এ হার আরও কমতে পারে। এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামীতে নীতি সুদের হার কমানোর দিকে এগুবে। এ হার কমানোর মাধ্যমে বাজারে ঋণের সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দেওয়া হবে। ঋণের সুদের হার কমতে শুরু করলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের গতি বাড়বে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক সংস্কারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ব্যাংক একীভূতকরণ এবং অধিগ্রহণসহ চলমান ব্যাংকিং খাতের সংস্কারগুলো এ খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে। তবে ব্যাংক খাতে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ এ খাতটির দুর্বলতাগুলো তুলে ধরছে। সরকারের আর্থিক চাপ কমাতে উন্নয়ন ব্যয় আংশিকভাবে হ্রাস করার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় জোরদার করার জন্য সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে প্রতিবেদনে এটিও বলা হয়েছে, আগের দুর্বলতাগুলো মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিকভাবে সন্তোষজনকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করেছে এবং স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। কিছু খাতে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো আগামীতে মোকাবিলা করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
