Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট

সমঝোতার কাছাকাছি

মনির হোসেন

মনির হোসেন

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সমঝোতার কাছাকাছি

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এবং আইনি ভিত্তি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে কঠোর অবস্থান দেখালেও পর্দার আড়ালে কিছুটা নমনীয় হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব কমেছে। সরকারের উদ্যোগে কিছু ইস্যুতে সমঝোতার প্রায় কাছাকাছি এসেছে দলগুলো। কয়েকটি প্রস্তাব সামনে রেখে এবং দুই দলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এই সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তারা প্রথমত সনদ বাস্তবায়নে গণভোট এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে হবে-এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এছাড়া পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনেরও সিদ্ধান্ত হতে পারে। গণভোটে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলোর ওপর বিভিন্ন দলের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) না রাখার মত তাদের। পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নে ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটিও তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু আগামী সংসদের জন্য সরকার একটি বিল তৈরি করে দেবে। অর্থাৎ জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত উভয় পক্ষের যে দাবি রয়েছে, সেসব দাবি মানার ক্ষেত্রে সরকার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। তবে দলগুলোর মধ্যে নিজস্ব উদ্যোগে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা হবে না। সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ঘোষণা করলে দলগুলো খুব বেশি আপত্তি করবে না। গত কয়েকদিনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তিতে সব পক্ষ এই অবস্থানে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এ ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সোমবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, গণভোট নিয়ে সরকার শিগ্গিরই সিদ্ধান্ত দেবে। জনগণের প্রত্যাশা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে যেটা ভালো মনে হয়, সরকার সেই সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, সরকার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আর আলোচনায় বসবে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। সরকারের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দল না মানলে কী হবে-জানতে চাইলে উপদেষ্টা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগে সরকার সিদ্ধান্ত নিক। কেউ তো বলেনি সরকারের সিদ্ধান্ত আমরা মানব না। আমি (রাজনৈতিক দল) যদি সিদ্ধান্ত না নিতে পারি, তবে সিদ্ধান্ত তো মানতে হবে। সরকার সম্ভাব্য সমাধান মাথায় রেখেই সবার সঙ্গে কথা বলে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। সেটা খুব দ্রুতই আপনাদের জানিয়ে দেওয়া হবে।’ প্রসঙ্গত, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ২৮ অক্টোবর সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকার একটি আদেশ জারি করবে। কিন্তু আদেশ জারির আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর আহ্বান করা হয়। কিন্তু দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। প্রকাশ্যে তারা মুখোমুখি অবস্থান নেয়।

বিএনপি বলছে, সংস্কার ও গণভোট চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে পারবে না। জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবিতে আন্দোলনে যাচ্ছে। আজ ঢাকায় বড় শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছে তারা। আর বিরোধ নিরসনে সরকারকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্যে অবস্থান এবং পর্দার আড়ালে কথাবার্তা এক নয়। সামনে ভোট। তাই মাঠ চাঙা রাখতে প্রকাশ্যে এক দল অন্য দলের বিরুদ্ধে বলবে। কিন্তু কখনোই এটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যাবে না। কারণ, সংকট বাড়লে এর সম্ভাব্য ঝুঁকি ও পরিণতি কী হতে পারে, সেটি অবশ্যই তাদের বিবেচনায় রয়েছে। সূত্র আরও জানায়, ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ জমা দেওয়ার পর সরকার একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। এ ব্যাপারে কমিশনের সঙ্গেও কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। ফলে সরকার আগেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে পারত। কিন্তু প্রথমেই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি বিরোধে যেতে চায়নি। এজন্যই দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে সময় বেঁধে দিয়েছে। এছাড়াও সাধারণ মানুষ দেখেছে, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হবে, এতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই। কারণ, এর বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের এখনো তিন মাস বাকি। আর তিন মাসে যে প্রস্তুতি থাকা দরকার, সরকার এর চেয়ে এগিয়ে আছে। সূত্রমতে, নির্বাচনের আগে গণভোটের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, গণভোট অনেক বছর পর হচ্ছে। এর বিষয়গুলো নিয়ে প্রচার-প্রচারণার ব্যাপার আছে। মানুষকে বিভিন্নভাবে বোঝাতে হবে। ফলে হঠাৎ করেই গণভোট দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়াও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি না থাকলে সেখানে তারা নেতিবাচক ক্যাম্পেইন করতে পারে। এটি ভোটের বড় একটি ঝুঁকি।

সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে বৃহস্পতিবারের বৈঠকটি শুধু আনুষ্ঠানিকতা। কারণ, জুলাই সনদ ইস্যুকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আগেই প্রধান উপদেষ্টার ওপর ছেড়ে দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের জন্য কয়েকজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান অন্যতম। আজ দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই উপদেষ্টাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের কথা রয়েছে। সেখানেই বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এর আগে সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে এ বিষয়ে উপদেষ্টাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার কথা হয়েছে। সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এক্ষেত্রে ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতা বাদ দিলেও আগামী সংসদের জন্য সরকার একটি বিল তৈরি করে দেবে।

সূত্র জানায়, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনে এখন আর বিএনপির আপত্তি নেই। কিন্তু এখন দলটির বড় ইস্যু নোট অব ডিসেন্ট। কারণ, মৌলিক ২০টি সংস্কারের ১১টিতে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। যেমন: তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন অন্যতম। এছাড়াও সনদে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলা হয়েছে। সেখানে কমিশনের সিদ্ধান্ত-বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, আইন কমিশন ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নিয়োগ সরকারের হাতে থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই বিশেষ সার্চ কমিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান, দলীয় প্রধান এবং সংসদনেতা থাকতে পারবেন না। আইনজীবীরা কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। এসব প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি। দলটির বক্তব্য-এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে নির্বাহী একেবারে দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়াও জুলাই সনদে উল্লেখ ছিল নোট অব ডিসেন্টসহ দলগুলো এই সনদ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করবে। এরপরও জনগণ তাদের ভোট দিলে প্রতিশ্রুতি অনুসারে সনদ বাস্তবায়ন করবে। অপরদিকে ঐকমত্য কমিশন, জামায়াত ও এনসিপির বক্তব্য হলো-৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬১টি প্রস্তাবের কোনোটিতে পূর্ণাঙ্গ এবং কোনোটিতে আংশিক নোট অব ডিসেন্ট আছে। ফলে এগুলো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া সনদের কোনো গুরুত্ব থাকে না। অন্যদিকে সরকার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী দলগুলো মিলে সংস্কার এবং বিএনপিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এটি দলটির জন্য একটি চাপ। ফলে তারা ছাড় দেবে। প্রাথমিকভাবে চাপ মোকাবিলায় মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে ২৩৭টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল। এদিকে প্রকাশ্যে এখনো মুখোমুখি বড় দুই দল। রোববার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে প্রতারণা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিতে ভিজে সংসদ ভবনের জুলাই সনদে সই করেছি। কিন্তু যে সনদে আমি সই করেছি, আর যেটি প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া হয়েছে, দুটি এক নয়। আমরা যে পাতায় সই করেছি, তা বাদ দিয়ে সেখানে অন্য পাতা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি স্পষ্ট প্রতারণা ও অন্যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কয়েকটি দল মিলে নির্বাচন দেরি করার চেষ্টা করছে। কারণ, তারা নির্বাচনকে ভয় পায়। তাই তারা নির্বাচন পেছাতে চায়। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, সমঝোতার কথাটি ঠিক নয়। এটি কীভাবে এলো, আমরা জানি না। তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক। কিন্তু কথাবার্তা মানেই সমঝোতা নয়। জামায়াতের এই নেতা বলেন, আমরা সব সময়ই সমঝোতার পক্ষে। এজন্য বিএনপিকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার সমঝোতার উদ্যোগ নিলে আমরা ভেবে দেখব আলোচনার এজেন্ডায় কী আছে। এরপর পরবর্তী সিদ্ধান্ত।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম