Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

করসীমা নির্ধারণে বৈষম্য

৮২% সরকারি কর্মচারী আয়কর থেকে মুক্ত

সাদ্দাম হোসেন ইমরান

সাদ্দাম হোসেন ইমরান

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

৮২% সরকারি কর্মচারী আয়কর থেকে মুক্ত

ফাইল ছবি

শুধু বেতন-বোনাস করযোগ্য হওয়ায় সরকারের ৮২ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী আয়করের বাইরে রয়ে গেছেন। এমনকি একই কারণে বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগের ৪ বছর পর্যন্ত আয়কর দিতে হয় না। পক্ষান্তরে বেসরকারি চাকরিজীবীদের কর্মজীবনের শুরু থেকে মোট বেতনের ওপর হিসাব কষে আয়কর দিতে হয়। সরকারের এই দ্বৈতনীতিকে বৈষম্য হিসাবে অভিহিত করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিভিন্ন নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন দিতে প্রতিবছর সরকারের খরচ হয় ৮৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে সরকার যদি অন্যান্য পেশার সবার মতো সরকারি চাকুরেদের আয়কর নির্ধারণ করে দিত তাহলে বিপুল অঙ্কের কর আদায় হতো। কিন্তু বর্তমানে কর্মচারীরা সরকারকে আয়কর দেন মাত্র ১৬১ কোটি টাকা। গড়ে একজন কর্মচারী আয়কর দেন ৬ হাজার ২২১ টাকা।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ যুগান্তরকে বলেন, কর ন্যায্যতার প্রশ্নে সব নাগরিকের কর সমান হওয়া উচিত। কে কোন পেশায় আছে সেটি বিবেচনায় নিলে সরকার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব পাবে না, একই সঙ্গে সমাজে বৈষম্য বাড়বে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হাসান বলেন, প্রতিবছর বাজেটে সরকার নারী-পুরুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য একটি করমুক্ত আয়ের সীমা নির্ধারণ করে। যাতে বলা হয়, পুরুষ নাগরিকের সাড়ে ৩ লাখ টাকা বার্ষিক আয় এবং নারীদের ৪ লাখ টাকা করমুক্ত। এই বৈষম্য সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেখানে সরকারি চাকরিজীবীদের শুধু মূল বেতন করযোগ্য, যেখানে বেসরকারি চাকরিজীবীদের পুরো বেতনের ওপর আয়কর দিতে হয়। এটা তো স্পষ্টত বৈষম্য। তিনি আরও বলেন, এই বৈষম্যের কারণে অনেকের কাছে মনে হতে পারে-সরকারি চাকরিজীবীরা সমাজের প্রিভিলেজ পারসন ও এলিট শ্রেণির। যত সুযোগ-সুবিধা তাদেরই যেন বেশি দেওয়া হয়। এ ধরনের নীতির দ্বৈততার কারণে সমাজে বৈষম্য আরও বাড়ছে। ফলে বৈষম্য দূর করতে হলে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মতো সরকারি চাকরিজীবীদেরও কর নির্ধারণ করা উচিত।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির (জিইএমএস) তথ্যমতে, মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদপ্তর, দপ্তর, করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা মিলিয়ে সরকারের মোট অনুমোদিত পদসংখ্যা ১৯ লাখ ১৯ হাজার ১১১টি। এই পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৮৯১ জন। এছাড়া সিভিল, সিডিজিএফ রেলওয়ে ও অন্য ক্যাটাগরিতে পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীর সংখ্যা ৮ লাখ ৩৫ হাজার ১৫ জন। এত বিপুলসংখ্যক চাকরিজীবীকে বেতন-ভাতা ও পেনশন দিতে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৮৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে।

২০১৭ সালে এনবিআর সরকারি কর্মচারীদের ভাতাকে করের আওতামুক্ত রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিভিন্ন স্বশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকরিজীবীরা করমুক্ত বিভিন্ন সুবিধা পান। এছাড়াও কোনো আইন, বিধি বা প্রবিধানের অধীনে কোনো পদে নিয়োজিত থাকাকালীন সরাসরি সরকারি কোষাগার হতে বেতন বা আর্থিক সুবিধা যারা পাবেন তারা করমুক্ত সুবিধা ভোগ করবেন। অন্যদিকে ২০২৩ সালে বেতন গ্রেড নির্বিশেষে সব শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের আয়কর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করে এনবিআর। একই সঙ্গে রিটার্নে সম্পদ বিবরণীও জমা দিতে বলা হয়। সেই থেকে কর্মচারীরা রিটার্ন দিয়ে আসছেন।

সম্প্রতি এনবিআর হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে বলেছে, পুরুষ কর্মচারীদের মাসিক মূল বেতন ২৬ হাজার ৭৮৫ টাকা এবং মহিলা কর্মচারীদের মূল বেতন ৩০ হাজার ৩৫৭ টাকার বেশি বেতন হলে উৎসে কর কর্তন করতে হবে। আয়কর আইন অনুযায়ী, একজন সরকারি কর্মচারীর শুধু বেতন-বোনাস করযোগ্য। এর বাইরে বাসা ভাড়া ভাতা, যা মূল বেতনের ৩০%-৫০%। চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, মহার্ঘ্য ভাতা, অব্যবহৃত ছুটি ভাতা, যানবাহন ভাতা প্রভৃতি পেয়ে থাকেন। যা করের আওতামুক্ত। যদিও বেসরকারি চাকরিজীবীদের মূল বেতন, বোনাস, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত ভাতাসহ মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর (এক-তৃতীয়াংশ বা সাড়ে ৪ লাখ টাকার নিচে যেই অঙ্ক কম, সেই অঙ্কে করছাড় রয়েছে। অর্থাৎ করমুক্ত।) নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হয়।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী বিসিএস ক্যাডার হিসাবে পে-স্কেলের ৯ম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়া হয়। জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার চার বছর পর্যন্ত তাকে কর দিতেই হয় না। মহিলাদের ক্ষেত্রে সেটি ৬ বছর। যদিও বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন থেকে উৎসে কর কেটে নেওয়া হয়।

এনবিআরের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সরকারি কর্মচারীরা ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আয়কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি একেবারেই যৎসামান্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১১ কোটি ৫৭ লাখ, ২০২১-২২-এ ১১৪ কোটি ৩ লাখ, ২০২২-২৩-এ ১২৫ কোটি ৭৫ লাখ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আয়কর দিয়েছেন ১৫০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অবশ্য কতজন সরকারি কর্মচারী নিয়মিত আয়কর দেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান এনবিআরের কাছে নেই।

জিইএমএসের তথ্য, আয়কর আইন ও সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯ম গ্রেড ঊর্ধ্ব কর্মচারীর সংখ্যা আনুমানিক ২ লাখ ৬০ হাজার জন। মূলত এরাই আয়কর দেন। বাকি নিচের সারির কর্মচারীরা শুধু রিটার্ন জমা দেন। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে মোট কর্মরতদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ আয়কর দেন এবং গড়ে একজন কর্মচারী বছরে সরকারকে আয়কর দেন মাত্র ৬ হাজার ২২১ টাকা।

তথ্যানিুসন্ধানে জানা গেছে, কর বৈষম্য কমিয়ে আনতে দুই বছর আগে সরকারি চাকরিজীবীদের ভাতার ওপর করারোপের সুপারিশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সে মোতাবেক এনবিআরও বাজেটে আয়কর আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এই বিধান আয়কর আইনে যুক্ত না করার নির্দেশ দেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম