বিল্ডিং কোডবিহীন ভবন টিকবে না
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভবন তৈরির কৌশল ও মান বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি)। সেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে কোথায় কী ধরনের মানসম্মত ভবন তৈরি করতে হবে তা বলা হয়েছে। বিএনবিসি অনুসরণ করে নির্মিত ভবনগুলো উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প সহনীয়। তবে যেসব ভবন বিএনবিসি অনুসরণ ছাড়াই তৈরি হচ্ছে সেগুলো টিকবে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
তাদের মতে, দেশে একেক অঞ্চলের ভবনের মান একেক রকম হবে। এটা ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিবেচনায় বিএনবিসিতে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। নগরাঞ্চলের মধ্যে ঢাকায় ৮ মাত্রার ভূকম্পন তীব্রতা সম্পন্ন ভবন, সিলেটে ৯ মাত্রার তীব্রতা সম্পন্ন ভবন তৈরির কথা বলা হয়েছে। সিলেট ও মধুপুর অঞ্চলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের যে অঞ্চলেই বড় মাত্রার ভূমিকম্প হোক না কেন, রাজধানী ঢাকায় তীব্রতা হতে পারে সর্বোচ্চ ৮। তবে ঢাকার আশপাশের এলাকায় বড় মাত্রার কোনো ভূমিকম্পের ঝুঁকি নেই। আগে শুধু দেশের নগর অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও এখন দেশের সব অঞ্চলই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। কেননা, দেশের সর্বত্র বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করেই ভবন তৈরি হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভবন পরিদর্শন করে বিএনবিসি অনুসরণ না করে ভবন নির্মাণের শত শত প্রমাণ পেয়েছে। নির্মাণগত ত্রুটির পাশাপাশি দুই হাজার ৬০৩টি ভবনে অগ্নিঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। আর নগরীর ৫৮টি বিপণিবিতানের সবকটিই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫টি, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ১৪টি এবং অতি ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রয়েছে ৯টি। এছাড়া ২০২৪ সালে সারা দেশে ২৫২টি সরকারি এবং ৯২৯টি বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজার ১৮১টি বহুতল ভবন (ছয়তলার উপরে) পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। ওই সময় ৩৬৭টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৭৪টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সুপারিশ পাঠানো হলেও কাউকে তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।
রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ১ হাজার ৮২৫টি স্থান থেকে মাটি নিয়ে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষাগারে আরও ১০ রকমের পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বালু দিয়ে ভরাট এলাকা ভূমিকম্পের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২৫২টি ভবন এবং রানা প্লাজা ধসের পর প্রায় ৩ হাজার ৫০০টি তৈরি পোশাক কারখানা নিয়ে জরিপ করা হয়। তবে এখনো পর্যন্ত আবাসিক ভবন নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। রাজউকের এ প্রকল্পের আওতায় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ভবন জরিপ করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৭০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২০৭টি হাসপাতাল, ৩৬টি থানা ও ৩০৪টি অন্যান্য ভবন রয়েছে।
রাজউকের গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও মাদ্রাসা বোর্ডের ভবন রয়েছে। এ ছাড়া সমীক্ষায় ১৮৭টি ভবনের ‘ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট’ করে সেগুলো মজবুত (রেকটিফাই) করতে বলা হয়েছে। এছাড়া রাজউকের তালিকায় বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে একটি ২০২২ এবং অন্যটি ২০০৮ সালে নির্মিত। হাজারীবাগের সালেহা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০১৮ সালে নির্মিত আটতলা একটি ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। সাভারের আশুলিয়ায় দোসাইদ একে স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০১৭ সালে নির্মিত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ বংশাল পুলিশ ফাঁড়ি ‘মৃত্যুফাঁদ’ : পুরান ঢাকার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের মাহুতটুলীতে শতবর্ষী বংশাল পুলিশ ফাঁড়ি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বহু আগেই ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও, ভাঙাচোরা দেয়াল, নড়বড়ে ছাদ ও ফাটল ধরা বারান্দার নিচেই প্রতিদিন ডিউটি করছেন ২৫ জন পুলিশ সদস্য।
শনিবার সকালে সরেজমিন ঘুরে যুগান্তরের হাজারীবাগ প্রতিনিধি জানান, প্রাচীন ভবনটি অত্যন্ত ক্ষয়প্রাপ্ত ও অস্থিতিশীল। দেওয়ালে ফাটল, স্যাঁতসেঁতে দাগ, ঝরে পড়া প্লাস্টার এবং দুর্বল কাঠের জানালা ও দরজা চোখে পড়ে। ভবনের ভেতরে ছোট গাছ জন্মেছে, উঠানে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে।
বংশাল থানার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই শেখ আলী আজহার যুগান্তরকে জানান, তারা পুরোপুরি জানেন ফাঁড়ির বর্তমান অবস্থায় ডিউটি করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২৩ সালের ৩০ জুন এর বারান্দা ধসে গিয়েছিল। শুক্রবার কোনো অংশ ধসে পড়েনি, তবে এই ভবনে ডিউটি অব্যাহত রাখলে যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
বিশেষজ্ঞ অভিমত : বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড ২০২০ (বিএনবিসি) প্রণয়নসংক্রান্ত স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সচিব এবং হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবু সাদেক শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিএনবিসি ভবনের গাইডবুক। সেখানে এলাকা ভেদে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিবেচনায় নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। সেগুলো মেনে ভবন তৈরি করলে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকবে ভবনগুলো। আর বিএনবিসি অনুসরণ না করলে উচ্চমাত্রার কম্পনে সেসব টিকবে না।
তিনি বলেন, বিএনবিসি ২০২০-এ দেশে বিশৃঙ্খল ভবন নির্মাণ নিয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়নে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত স্থাপত্য নকশার পাশাপাশি অন্যান্য নকশা অনুমোদনের বাধ্যবাধকতার সুপারিশ করেছে। সেসব বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এসব বাস্তবায়ন না হলে ভবনগুলো ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রায় হুড়মুড় করে ধসে পড়বে।
তিনি জানান, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বোঝার রয়েছে। প্রথমত-ভূমিকম্পের মাত্রা এবং দ্বিতীয়ত-ভূমিকম্পের তীব্রতা। ভূমিকম্পের মাত্রা সর্বোচ্চ ৯.৯ হতে পারে। আর ভূমিকম্পের তীব্রতা সর্বোচ্চ ১২ পর্যন্ত হতে পারে। উৎপত্তিস্থলে ভূমিকম্পন কত শক্তি নির্গত করেছে, তার পরিমাণকে ভূমিকম্পের মাত্রা বলে। আর ভূমিকম্পের তীব্রতা হলো মানুষের অনুভূমি, ভবনের ক্ষতি এবং চারপাশের সামগ্রিক প্রভাব। ভূমিকম্পের মাত্রা কম হলেও তীব্রতা বেশি হয়ে থাকে। তবে এলাকাভেদে এর ভিন্নতাও থাকতে পারে। বেশি দূরত্বের এলাকায় তীব্রতা কম অনুভূত হয়।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজউক বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগ সহনশীল ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে। সেখানে প্রত্যেক এলাকার ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনুযায়ী কী ধরনের ভবন তৈরি করা যাবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান ড্যাপে ওই পরিকল্পনা যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এরপর ড্যাপ সংশোধন হবে সেখানে ওই পরিকল্পনা যুক্ত করা হবে। প্রতি ৫ বছর অন্তর রাজউক ড্যাপ সংশোধন করবে। এখনো রাজউক বিএনবিসি অনুসরণ করে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। কেউ বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অর্থাৎ, রাজউক ৮ তীব্রতা সহনশীল ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

