Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বড় ভূমিকম্প মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত

উদ্ধার অভিযানে সক্ষমতার ঘাটতি ফায়ার সার্ভিসের

ইমন রহমান

ইমন রহমান

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উদ্ধার অভিযানে সক্ষমতার ঘাটতি ফায়ার সার্ভিসের

প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। তীব্র ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প দিচ্ছে সতর্কবার্তা। আতঙ্কে পুরো দেশবাসী। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বহুতল ভবনে বসবাসকারীরা আছেন বেশি ঝুঁকিতে। দেশে ভূমিকম্প হলে উদ্ধার অভিযানে প্রথমেই ডাক পড়ে ফায়ার সার্ভিসের। তবে বৃহৎ আকারের ভূমিকম্প হলে উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা একেবারেই তলানিতে। সারা দেশে মাত্র ১৪ হাজার ৫৬০ জনের জনবল রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের। নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতিও। এর মধ্যে ঢাকার ১৮টি স্টেশনে আছে মাত্র ৬৫০ জনবল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কাজ একত্রে করতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে। কেননা ভবনের গ্যাসের লাইন ফেটে আগুন ছড়িয়ে যাবে। রাজধানীতে সাড়ে ২১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। আর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন রয়েছে মাত্র ১৮টি। এসব স্টেশনে যে জনবল ও যন্ত্রপাতি রয়েছে তা দিয়ে একযোগে মাত্র ২০ থেকে ২৫টি ধসে পড়া ভবনে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে। তবে ভবন ধসে সড়ক বন্ধ হয়ে গেলে ফায়ার সার্ভিসের মুভ করার সক্ষমতাও থাকবে না। ফলে দেশবাসীর মহা এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মেগা ভূমিকম্প হলে কোনো দেশের ফায়ার সার্ভিসের পক্ষেই এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবক) প্রস্তুত করছে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিসকে ডিসেন্ট্রালাইজ করা হয়েছে।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শহর থেকে গ্রামে অধিকাংশ ভবন জাতীয় বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি না হওয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি অনেক বেশি। এক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত ভলান্টিয়ার বাড়ানোর বিকল্প নেই।

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রি. জে. (অব.) আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা কী ধরনের হওয়া উচিত সেটি নিয়ে ইউএনডিপির সহায়তায় ফায়ার সার্ভিস ২০২১ সালে একটি প্ল্যান দিয়েছিল সরকারকে। সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে। সেই অনুযায়ী কাজ করার কথা, কিন্তু আজ পর্যন্ত হয়নি।

তিনি আরও বলেন, বেতনভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এটা উন্নত দেশের পক্ষেও সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন ভলান্টিয়ার। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসে ৬২ হাজার আরবান কমিউনিটি ভলান্টিয়ার তৈরি করার চেষ্টা করেছিলাম। ইউএনডিপির সহযোগিতায় আমরা যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম তাতে ৪০ হাজারের মতো ভলান্টিয়ার তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে দুই থেকে তিন লাখ ভলান্টিয়ার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিন লাখ দূরের কথা ৬২ হাজারই পুরা করা সম্ভব হয়নি।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি। ভলান্টিয়ারদের ইকুইপমেন্ট (যন্ত্রপাতি) কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য সরকারের হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ফায়ার সার্ভিসের ৫৩৭টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আছে ১৮টি স্টেশন ও দুটি বিশেষ টিম। বিশেষ টিম দুটি পূর্বাচল ও মিরপুর দশ নম্বরে থাকে। আর ফায়ার সার্ভিসের মোট জনবল রয়েছে ১৪ হাজার ৫৬০ জন। এর মধ্যে ঢাকার স্টেশনগুলোতে আছে ৬৫০ জনবল। প্রয়োজনের তুলনায় এই জনবল অনেক কম বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্টরা। ভূমিকম্পের পর উদ্ধার অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও কম। হাইড্রোলিক কাটার, হাইড্রোলিক স্প্রেডার, হাইড্রোলিক র‌্যাম, এয়ার লিফটিং ব্যাগ, সার্চ ভিশন ক্যামেরা, রোটারি রেসকিউ ‘স’, চিপিং হ্যামার, রেসিপ্রোকেটিং ‘স’ ও চেইন ‘স’ বেশি প্রয়োজন হলেও এগুলো অপর্যাপ্ত।

ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভূমিকম্পের পর কেউ ভবনে আটকে থাকলে তাদের উদ্ধারে হেভি ইকুইপমেন্ট প্রয়োজন। যেমন কাটিং টুলস থেকে শুরু করে ড্রিলিং টুলস, থার্মাল ইমেজার প্রভৃতি। ক্যামেরার মাধ্যমে দেখা হয় বিধ্বস্ত ভবনের মধ্যে মানুষ আটকে আছে কিনা বা বেঁচে আছে কিনা। এগুলো নিয়ে ভলান্টিয়ার এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা একত্রে ভূমিকম্পে উদ্ধার অভিযানে বিরাট একটা ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৬২ হাজার ভলান্টিয়ার তৈরির কথা ছিল এবং বর্তমানে দুই থেকে তিন লাখ হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশে যতগুলো সিটি করপোরেশন ও ওয়ার্ড আছে সবগুলোতে ২০০ জন করে এবং ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টাসে ২০০ জন করে ভলান্টিয়ার তৈরির হিসাব করা হয়েছিল।

তারা বলছেন, ফায়ার সার্ভিসের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। প্রত্যেক স্টেশনে এসব যন্ত্রপাতি থাকতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাশাপাশি ভলান্টিয়াররাও সেই স্টেশনের সদস্য হিসাবে তালিকাভুক্ত হবেন। ভলান্টিয়াররা যন্ত্রপাতিগুলো বের করে প্রশিক্ষণ নেবেন। এতে সব সময় প্রশিক্ষিত একটি বিরাট জনবল থাকবে।

ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এমনিতেই ফায়ার সার্ভিসের জনবল ও যন্ত্রপাতি পর্যাপ্ত নয়। এর ওপর বড় ধরনের ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার অভিযানের জন্য যা যা প্রয়োজন তা নেই। রাজধানীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে একযোগে ২০ থেকে ২৫টি বহুতল ভবনে উদ্ধার অভিযানের সক্ষমতা রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া শাখার কর্মকর্তা মো. শাহজাহান সিকদার যুগান্তরকে বলেন, আমরা ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য ৬২ হাজার ভলান্টিয়ার ডেভেলপ করছি যার ৫৫ হাজার অলরেডি প্রস্তুত হয়েছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ডিসেন্ট্রালাইজ করা হয়েছে যেন একটি ভবন ভেঙে পড়লে সব কর্মকর্তা আটকে না যায়, কমান্ড ফেল না করে।

পূর্বাচলে ৬০ জনের একটি টিম প্রস্তুত রয়েছে উল্লেখ করে শাহজাহান সিকদার বলেন, জেলা পর্যায়সহ আমাদের সব স্টেশনে ভূমিকম্পে উদ্ধার কাজ করার মতো ইকুইপমেন্ট রাখা আছে। তবে একটা মেগা ডিজাস্টার হলে সেটি মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত জনবল আমাদের নেই। এটা উন্নত দেশেও নেই। এটার জন্য আমাদের দেশের যে এসওডি আছে (স্ট্যান্ডার্ড অর্ডার অ্যান্ড ডিজাস্টার) তার ভিত্তিতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ সব বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করব দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য। পাশাপাশি আমাদের ভলান্টিয়াররা আমাদের সহযোগিতা করবে এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়া হবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম