Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বড় দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে দেশ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বড় দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে দেশ

চার বছর ধরেই বাংলাদেশে বাড়ছে দারিদ্র্যের হার। দেশের ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ এখন রয়েছে দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে। মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। এর আগে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ জরিপেও পাওয়া গেছে দারিদ্র্য বৃদ্ধির তথ্য। দারিদ্র্য বাড়ার মূল কারণ এবং সরকারের করণীয় বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন দুই অর্থনীতিবিদ। তাদের মতে, বিনিয়োগ এখন স্থবির। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নেই, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও কারণ

ড. এমকে মুজেরী

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতার ফসল হিসাবেই দারিদ্র্য বাড়ছে। এছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধীরগতি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বা বিদেশি সব ধরনের বিনিয়াগই স্থবির। ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। গত সরকারের শেষদিক থেকে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশেই ঘোরাফেরা করেছে। এখনো ৮ শতাংশের ওপরেই রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে ক্রয়ক্ষমতা নিচে নেমে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ায় তা গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বেশি আঘাত হানছে। কেননা নিম্ন আয়ের মানুষ যা আয় করে তার বেশির ভাগই চলে যায় খাবার কেনার পেছনে। এজন্য আরও বেশি মানুষ দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬ কোটির বেশি মানুষ এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। এছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধি খুব বেশি হয়নি। দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে নতুন কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ বিনিয়োগ অনুকূল নয়। পাশাপাশি দারিদ্র্য কমানোর মতো কার্যক্রম অর্থনীতিতে অনুপস্থিত। দেশীয় উৎপাদন বাড়েনি। গত অর্থবছরে জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল এ অর্থবছরে তার চেয়ে বেশি কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। সেই সঙ্গে আছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। দেশে যদি একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় তাহলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে নির্বাচন হলেই যে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এমনটা বলা যায় না। নির্বাচন সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এবং সব দলই যদি ফলাফল মেনে নেয় তাহলে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হতে পারে। তখন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করবে। তাই বলা যায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো কিছুই হবে না। যতদিন রাজনীতিতে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকবে, ততদিন দারিদ্র্য আরও বাড়বে। আসলে শান্তি না এলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ না বাড়লে অর্থনীতিতে গতিশীলতাও আসবে না।

এদিকে সরকার পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আগের মতোই আছে। টাকার অঙ্ক কিংবা পরিসর কোনোটিই বাড়েনি। কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কৃষি উৎপাদনেও সমস্যা। কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। শ্রমিকের মজুরি হার বাড়েনি। অর্থনীতির গতিহীনতা আছে। এগুলো সবকিছুই দারিদ্র্য হার বাড়ানোর জন্য দায়ী।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)

মূল্যস্ফীতি ও মজুরির ভারসাম্যহীনতায় এই অবস্থা

ড. জাহিদ হোসেন

বিশ্বব্যাংকের যে প্রতিবেদন সেটি মূলত বিবিএস’র খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে করা হয়েছে। ২০১৬ সালের আগে দেশে দারিদ্র্য হার ক্রমান্বয়ে কমছিল। ২০১৬-২০২২ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে দারিদ্র্য হার বাড়ছে। এর পেছনে নিকটবর্তী কারণ হলো মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার এখন কিছুটা কম থাকলেও ৮ শতাংশের ওপরেই আছে। অথচ যারা দরিদ্র বা ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের আয় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না। চার বছর ধরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতি মাসে যে মজুরি হারের সূচক প্রকাশ করছে, সেখানে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির চেয়ে মজুরি হারের বৃদ্ধি পেছনেই রয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধারাবাহিকভাবে কমেছে। বিবিএস যে তথ্য দেয় সেগুলো উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের আয় হিসাবে ধরা হয় না। এখানে নিম্ন আয়ের মানুষ যেসব পেশার সঙ্গে যুক্ত তাদের মজুরি হিসাব করা হয়ে থাকে। তাই মূল্যস্ফীতি ও মজুরি হারের মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা সেটিই ধরতে গেলে দারিদ্র্য হার বাড়ার অন্যতম কারণ। তাই দারিদ্র্য নিরসন করতে গেলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তবে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো যথেষ্ট নয়। দারিদ্র্য হার কমাতে হলে শোভন কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এতে শ্রমিকের মজুরি বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গতি তৈরি করবে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে হবে। এটা ভালো কথা বলা হয়েছে। কেননা বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়লে শিল্পকারখানা, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর উৎপাদনের গতি অব্যাহত থাকবে। এতে কর্মসংস্থান ও মজুরি বাড়বে। গ্রাম ও মফস্বল শহরগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানো গেলে মানুষ নিজেরাই এমন কিছু উদ্যোগ নিতে পারবে যাতে করে তাদের আয় বেড়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, কানেক্টিভিটি অর্থাৎ যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে রাস্তা অনেক হয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক মুভমেন্ট বাড়েনি। এজন্য ভোগান্তিমুক্ত, চলাচলযোগ্য যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। কৃষকরা এখন যেমন নিজ এলাকাতেই তাদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা বড় বাজারে সরাসরি আসতে পারেন না। এই যোগাযোগ শুধু অবকাঠামো উন্নয়নই নয়, ইন্টারনেটসহ ডিজিটাল যোগাযোগকেও উন্নত করতে হবে। তাহলে কৃষক ফোনেই জানতে পারবেন কোন বাজারে কোন পণ্যের দাম কত। সে হিসাবে পাইকারদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারবেন। অথবা নিজেরাই পণ্য নিয়ে বাজারে আসতে পারবেন।

এদিকে দেশের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শিখছে না কিছুই। এছাড়া আমাদের শিক্ষা জীবিকা-আহরণ সহায়ক নয়। শিক্ষার মান বাড়িয়ে শিক্ষাকে কর্মের উপযোগী করতে হবে। দারিদ্র্য বাড়ার পেছনে দুর্নীতি বড় সমস্যা। এটা যদিও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। এ দেশে সুশাসনের চরম অভাব আছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সব জায়গায়ই উদ্বেগ আছে। সব জায়গায় খরচ হয় ঠিকই, কিন্তু ফল আসে না। দুর্নীতিই এখানে বড় সমস্যা। এটা বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে আসেনি। এই দুর্নীতি কমানোর উপায় হলো-প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিএনএ’র মধ্যেই দুর্নীতি ঢুকে গেছে। এক কথায় ডাক্তার (প্রতিষ্ঠানগুলো) যদি নিজেই অসুস্থ থাকে, তাহলে রোগ সারাবে কে? তাই ডাক্তারকে আগে সুস্থ করতে হবে।

লেখক : সাবেক লিড ইকোনমিস্ট, বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম