ন্যাশনাল গার্ডের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়া
তৃতীয় বিশ্ব থেকে অভিবাসী নেবেন না ট্রাম্প
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশ’ থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে স্থগিত করার পরিকল্পনা করছেন। তবে তিনি কোন দেশগুলোকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ বুঝিয়েছেন-সেটি পরিষ্কার করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে একজন আফগান নাগরিক মার্কিন ন্যাশনাল গার্ডের দুজন সদস্যকে গুলি করেছেন বলে অভিযোগ ওঠার একদিন পর বৃহস্পতিবার ট্রাম্প এমন ঘোষণা দিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা পুরোপুরি স্থিতিশীল করার সুযোগ করে দিতে তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ থেকে অভিবাসন আমি স্থায়ীভাবে স্থগিত করব।’ খবর বিবিসির। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও লিখেছেন, তার পূর্বসূরি জো বাইডেনের আমলে দেওয়া ‘লাখ লাখ’ অভিবাসনের অনুমোদন বাতিল করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রকৃত সম্পদ নন-এমন যে কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। এর আগে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা দেয়-১৯টি দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা নাগরিকদের গ্রিনকার্ড পর্যালোচনা করে দেখা হবে। মার্কিন নাগরিকত্ব ও অভিবাসন পরিষেবা বিভাগের (ইউএসসিআইএস) প্রধান জোসেফ এডল বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ঝুঁকিপূর্ণ বা উদ্বেগের তালিকায় থাকা ১৯টি দেশ থেকে আসা প্রত্যেক নাগরিকের গ্রিনকার্ড কঠোরভাবে পর্যালোচনা করতে তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। ট্রাম্পের নির্দেশ-‘যেসব দেশ নিয়ে উদ্বেগ আছে, সেসব দেশ থেকে আসা প্রত্যেক বিদেশির গ্রিনকার্ড পূর্ণাঙ্গ ও কঠোরভাবে পুনঃপর্যালোচনা করতে হবে।’ হোয়াইট হাউজ জুন মাসের এক ঘোষণায় ১৯টি দেশের নাম প্রকাশ করে। ওই ঘোষণায় বলা হয়, বিদেশি সন্ত্রাসী এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য বিদেশি নাগরিকদের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। সেখানে ১২টি দেশের নাগরিকদের প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ পুরোপুরি আরোপের কথা বলা হয়। দেশগুলো হলো-আফগানিস্তান, মিয়ানমার, শাদ, রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো, ইকোয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেন। আর সাতটি দেশের ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়। এগুলো হলো-বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান ও ভেনিজুয়েলা।
সর্বশেষ বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে এক আফগান নাগরিকের গুলিতে দুই ন্যাশনাল গার্ড সদস্য গুরুতর আহত হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর গ্রিনকার্ড পুনরায় যাচাই করার ঘোষণাটি আসে। গুলিবিদ্ধ দুজনের মধ্যে একজন পরে মারা যান। এ ঘটনায় অভিযুক্ত রহমানুল্লাহ লাখানওয়াল ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানদের জন্য বিশেষ অভিবাসন সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। সেই কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে আসেন লাখানওয়াল।
গ্রিনকার্ডের পুনঃপর্যালোচনা কীভাবে হবে, সে বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য সেখানে দেওয়া হয়নি। জুন মাসের ঘোষণার ব্যাপারে বিবিসিকে ট্রাম্প প্রশাসন জানায়-নিরাপত্তাসংক্রান্ত উদ্বেগের পাশাপাশি ব্যবসা, ছাত্র ও পর্যটক ভিসায় এসে অতিরিক্ত সময় আমেরিকা অবস্থান করার মতো কারণেও কোনো কোনো দেশকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ওই ঘোষণায় আফগানিস্তানের ব্যাপারে বলা হয়েছে-স্পেশালি ডেজিগনেটেড গ্লোবাল টেরোরিস্ট গ্রুপ (বিশেষভাবে চিহ্নিত বৈশ্বিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী) তালেবান আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে পাসপোর্ট বা নাগরিক নথি ইস্যু করার জন্য দক্ষ বা সহযোগী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই এবং যথাযথ স্ক্রিনিং ও যাচাই ব্যবস্থা নেই। অতএব অভিবাসী ও অনভিবাসী আফগান নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার বাতিল করা হলো। বুধবার আফগানদের সব অভিবাসন আবেদন প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নাগরিকত্ব ও অভিবাসন পরিষেবা জানিয়েছে-‘নিরাপত্তা ও যাচাই প্রটোকল’ পর্যালোচনার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রথম মেয়াদের শুরুতে সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৫ সালে তিনি যে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন-আসলে কী ঘটছে সে বিষয়ে আমাদের দেশের প্রতিনিধিরা বুঝতে না পারা পর্যন্ত মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে, সেই ঘোষণারই ধারাবাহিকতা ছিল এটি। এর ফলে ওই সময় বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার পর্যটক, অভিবাসী, ব্যবসায়ী এবং মার্কিন গ্রিনকার্ডধারীরা তাৎক্ষণিকভাবে বিমানবন্দরে প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েন। কারণ বিমান সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন কর্তৃপক্ষ বিস্তারিত তথ্য বের করার চেষ্টা করে। অনেককে মাঝপথে ফেরত পাঠানো হয় অথবা যুক্তরাষ্ট্রগামী ফ্লাইটে উঠতে বাধা দেওয়া হয়। চলতি বছরের জুন মাসে আরোপিত প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার বিস্তারিত জানাতে হোয়াইট হাউজের দেওয়া বিবৃতির শুরুতে-২০১৭ সালে নিজের প্রথম মেয়াদে জারি করা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা বলেছিলেন ট্রাম্প। তখন এটিকে অনেক সময় ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’ বলা হতো। নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের মানুষের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনা তখন বিভিন্ন আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং অনেকবার সংশোধনও করা হয়। উচ্চ আদালত এটি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করার রায় দেয়।
কোন দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশ? : অভিবাসন বন্ধে ট্রাম্পের হুমকি ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে-কারা তৃতীয় বিশ্বের দেশ? ট্রাম্প তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে কাদের বুঝিয়েছেন-সেটি পরিষ্কার করেননি। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্ব ধারণাটি এসেছে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে। তখন বিশ্ব মূলত দুটি শক্তিশালী শিবিরে বিভক্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত পশ্চিমা ব্লক এবং কমিউনিস্ট সমর্থিত পূর্ব ব্লক। এই দুই ব্লকের বাইরেও অবস্থান ছিল অনেক দেশের। সেগুলোকে সংজ্ঞায়িত করতে প্রথম প্রয়োগ ঘটেছিল তৃতীয় বিশ্ব শব্দটি। পরবর্তীকালে শব্দটি প্রায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র বা ‘অনুন্নত’ দেশ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। যদিও এখন এটি ব্যাপকভাবে সেকেলে বা অপ্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হয়।
ঐতিহাসিকভাবে, প্রথম বিশ্ব বলতে বোঝানো হতো যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গণতান্ত্রিক ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে। দ্বিতীয় বিশ্ব বলতে বোঝানো হতো শ্রমিক-কৃষক নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোকে, আর তৃতীয় বিশ্ব বলতে সেসব দেশকে বোঝানো হতো, যারা কোনো ব্লকের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। প্রথম বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল-উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। পশ্চিমা প্রভাবের কারণে কিছু আফ্রিকান অঞ্চলও এ তালিকায় ধরা হতো। যেমন স্পেনের অধীনে পশ্চিম সাহারা, বর্ণবাদী শাসনামলের দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকা (নামিবিয়া)। অন্যদিকে অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিক ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পর্তুগিজ শাসনে ছিল, পরে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডের মতো নিরপেক্ষ দেশগুলোও কার্যত প্রথম বিশ্ব হিসাবেই বিবেচিত ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ও পূর্ব ইউরোপ। যেমন-পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়া ও বলকান অঞ্চল এবং চীন সমর্থিত এশিয়ার কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো। যেমন-মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া। এছাড়া তৃতীয় বিশ্ব ছিল-বাকি সব দেশ। এগুলো মূলত আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অপেক্ষাকৃত অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশ।
