রাজউকের প্লট দুর্নীতির আরেক মামলা
হাসিনার ৫ রেহানার ৭ টিউলিপের ২ বছর দণ্ড
শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও টিউলিপ সিদ্দিক
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে রাজউকের প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৫ বছর, বোন শেখ রেহানা ৭ বছর এবং রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিককে ২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাসের দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে রেহানার প্লটের বরাদ্দ বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রায়ে রেহানার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন ও বিধি ভঙ্গ করে জালজালিয়াতির মাধ্যমে পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এখানে শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা ও প্রভাব প্রয়োগ করে বোন রেহানাকে প্লট বরাদ্দে সহায়তা করেন। ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। একই সঙ্গে টিউলিপ তার মা রেহানাকে প্লট পাইয়ে দিতে খালা শেখ হাসিনাকে চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তার করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম এ রায় ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।
এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের পর ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে প্লট বরাদ্দে জালিয়াতির তিন মামলায় ২১ বছরের দণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পৃথক দুই মামলায় হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পাঁচ বছরের দণ্ড দেন আদালত। তারা সবাই পলাতক। এছাড়াও পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির আরও দুটি মামলা একই আদালতে বিচারাধীন। ওই দুই মামলায় শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর সঙ্গে শেখ হাসিনা ও টিউলিপও আসামি।
প্লট দুর্নীতি মামলায় ১৭ আসামির মধ্যে বাকি ১৪ জনের প্রত্যেককে পাঁচ বছর করে সাজা দিয়েছেন আদালত। তারা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পুরবী গোলদার, অতিরিক্ত সচিব অলিউল্লাহ, সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের পিএ মো. আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, তন্ময় দাস, মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, মেজর (ইঞ্জি.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.), সাবেক পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম এবং উপপরিচালক নায়েব আলী শরীফ।
‘দুর্নীতি বর্তমানে রোগে পরিণত হয়েছে’-পর্যবেক্ষণে আদালত : আসামিদের মধ্যে রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম কারাগারে আছেন। হাসিনা, রেহানা, টিউলিপসহ বাকিদের পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচারকাজ চলে। ফলে তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা লড়ার সুযোগ পাননি।
কেন তারা আইনজীবী নিয়োগের সুবিধা পাননি, রায়ের পর্যবেক্ষণে তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ায় পৃথিবীর যেখানে অবস্থান করুক না কেন, সেই আসামির বিচার করতে আইনে কোনো বাধা নেই। কেবল মৃত্যুদণ্ড ধারার মামলার ক্ষেত্রে পলাতক আসামির ক্ষেত্রে ডিফেন্স লয়ার নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। মৃত্যুদণ্ডযোগ্য ধারা না থাকলে মামলায় পলাতক আসামির ক্ষেত্রে ডিফেন্স লয়ার নিয়োগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আসামিকে আগে আত্মসমর্পণ করতে হয় এবং পরে বিচার দাবি করতে হয়। অন্যথায় আসামি বিচারিক সুবিধা পেতে পারেন না। শেখ হাসিনা ফৌজদারি অসদাচরণ করেছে উল্লেখ করে আদালত বলেন, আসামি শেখ রেহানা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্ররোচিত করে পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পে প্লট নিয়েছেন। আসামি টিউলিপ সিদ্দিক মা রেহানা সিদ্দিককে প্লট পাইয়ে দেওয়ার জন্য খালা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, হাসিনার একান্ত সচিব সালাউদ্দিনকে মোবাইল ও ইন্টারনেটের বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে এবং বাংলাদেশে এলে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন। এটি দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং তাদের জবানবন্দিতে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়াও দুর্নীতি প্রসঙ্গে আদালত বলেন, দুর্নীতি বর্তমানে রোগে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমাদের সমাজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন, পাপ ও জুলুমের ক্ষেত্রে একে অপরকে সহায়তা করো না।
প্রথমবার কোনো ব্রিটিশ এমপি দোষী সাব্যস্ত : বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো ব্রিটিশ এমপির বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষণা হলো। এর আগে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার ঘনিষ্ঠ এক ডেভেলপারের কাছ থেকে লন্ডনে প্রায় ৭ লাখ পাউন্ড মূল্যের একটি ফ্ল্যাট ‘উপহার’ পাওয়ার অভিযোগ উঠলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের সিটি মিনিস্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেন টিউলিপ।
হাসিনা-রেহানা-টিউলিপকে ফেরাতে চায় দুদক : দুদকের পিপি মইনুল হাসান বলেন, যেসব দেশে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, টিউলিপসহ অন্য আসামিরা পলাতক আছেন, সেসব দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করব। ইন্টারপোলের সহায়তায় তাদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা নেব আমরা। টিউলিপ একদিকে বাংলাদেশের নাগরিক আবার যুক্তরাজ্যেরও নাগরিক। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমরা টিউলিপের সাজার বিষয়টি অবহিত করব। আইনের যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে দেশে ফেরানো যায়, সেসব প্রক্রিয়া আমরা সম্পন্ন করব। তিনি বলেন, এ রায় আমাদের প্রত্যাশামতো হয়নি। আমরা সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন চেয়েছিলাম। কথা বলে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব। তিনি আরও বলেন, টিউলিপ কখনো ফোন কল, কখনো অ্যাপ ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে প্লট বরাদ্দের জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মচারীরা এসে এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। আমরা মামলাটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।
মামলার অভিযোগে যা আছে : পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে ১৩ জানুয়ারি মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক সালাহউদ্দিন। তদন্ত শেষে ১০ মার্চ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। ২৫ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের জন্য ১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন।

