নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা মেরুকরণের সম্ভাবনা
নতুন কোনো বার্তা দেবেন কি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অনেক জল্পনা-কল্পনা ও প্রত্যাশার পর অবশেষে আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার এই দেশের ফিরে আসার ঘটনা দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তাদের মতে, দেশের বিভক্ত তথা বিবদমান এই সমাজে সবাই এখন তারেক রহমানের দিকেই তাকিয়ে আছেন। ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার ব্যবস্থার দায়িত্ব তাকেই গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচনে সহিংসতা পরিহার, সব গোলযোগ দমন এবং দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও নির্ভর করছে তার ওপর। এই প্রক্রিয়ায় অনেক দলকে বেশ কিছু আসনে ছাড় দিয়ে হলেও একটি সুন্দর পরিবেশের উদ্যোগ গ্রহণ কেবল তারেক রহমানই পারেন। এমনকি নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টিও আলোচনায় আনতে পারেন তারেক রহমান। এসব কারণ বিবেচনায় রেখে কেউ কেউ বলছেন, ফিরে আসার পর দেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু চমক দেখাতে পারেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, সম্ভাব্য এই চমকে আসন সমঝোতার বিষয়েও আসতে পারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তারেক রহমান এখন শুধু বিএনপির নয়, দেশের মানুষের আশা ও ভরসার একমাত্র স্থল। এজন্য তিনি সব দিক রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করতে পারেন-এমন আলোচনা উঠছে রাজনীতিতে। বলা হচ্ছে, তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আস্থায়ও নিতে পারেন।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিএনপির ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফার প্রথমেই জাতীয় সরকারের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জয়লাভের পর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। যাকে জাতীয় সরকার উল্লেখ করে ৩১ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে একাধিকবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ৩১ দফার কথা বারবার উল্লেখ করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, আগামী ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষদিন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে আসার পর চার দিন বাকি থাকবে। এই চার দিনে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন হতে পারে। মনোনয়নকেন্দ্রিক বিভিন্ন জায়গায় বিরোধ, শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগিসহ নানা বিষয় সমাধান হতে পারে। এমনও হতে পারে তিনি ঐক্যের ডাক দিতে পারেন। সব মিলিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতার উপস্থিতি রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ দেশে যে শাসন দিয়েছে, নির্বাচনের পর সরকার গঠন করলে বিএনপিকে সেই শাসনের বিপরীতে সুশাসন দিতে হবে। বিএনপিকে বোঝাতে হবে সে কেন ভিন্ন! বিএনপি যে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে পারে, বাংলাদেশের ভরসা ও রক্ষা করার একটা জায়গায় আছে, তা সরকারে গেলে বিএনপিকে বোঝাতে হবে। এতদিন মাঠে-ময়দানে বিএনপি যে অঙ্গীকারটা করেছে তার বাস্তবায়ন দেখাতে হবে।
দেশে নানা ধরনের মব ভায়োলেন্সের পর একটা প্রতিকূল পরিবেশে দেশে ফিরে আসছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তাই দেশবাসীর পাশাপাশি সুধী সমাজের নজরও এখন তারেক রহমানের দিকে। তার ‘ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ উপলক্ষ্যে রোববার আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, দেশে একটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা বিপজ্জনক। এ প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের আরও আগে দেশে ফেরা সম্ভব হলে বিএনপি ও দেশের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হতে পারত।
তারেক রহমানের ফেরার আগেই ঘটে গেছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছুটা সহিংসতা ও সংঘাত আছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে কীভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সবাই সেদিকেই তাকিয়ে আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, একমাত্র তারেক রহমানই পারবেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে। কারণ বিএনপি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় দল। জনগণ মনে করছে বিএনপিই ক্ষমতায় চলে আসবে। কিন্তু ক্ষমতায় চলে আসা এবং তারপর টিকে থাকা তার চেয়েও কঠিন বলে দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আলোচনা আছে। ফলে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি ইতিবাচক সব উদ্যোগ বিএনপি তথা তারেক রহমানকেই নিতে হবে।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনি সমঝোতা হয়েছিল। এবারও নির্বাচনি সমঝোতা হলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা আছে। যদিও বিএনপি তিনশ আসনের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মনোনয়ন ইতোমধ্যে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। এখনো অন্য দলের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। বিশেষ করে দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।
কারণ, বাংলাদেশে এখন এক ধরনের বৈরী পরিস্থিতি চলছে। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে অনুপস্থিত থাকা এবং পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যে টানাপোড়েন, তাতে দেশে স্থিতিশীলতা নিয়ে নানা গুজব ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠান অত্যন্ত কঠিন-তৈরি করা হচ্ছে এমন বয়ান। এমন পরিস্থিতিতে তারেক রহমান সব দিক সামাল দিয়ে একটি নতুন নির্বাচনি পরিবেশ তৈরি করতে পারবেন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। তাদের মতে, একমাত্র তারেক রহমানই এমন অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে পারেন। সুধী সমাজের মধ্যে আলোচনা আছে, এই মুহূর্তে এই প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব একমাত্র তারেক রহমানেরই আছে। কারণ তার বক্তব্যে একটি অন্তর্ভুক্তমূলক সমাজ গঠনের কথা আছে। ফলে তিনি আসার পরে দেশের রাজনীতিতে অনেক চমক থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, তারেক রহমান দেশে ফেরার পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে ডান, বাম, মধ্যপন্থি ও ইসলামিসহ সব দলের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টিও তারেক রহমানের আসার পর স্পষ্ট হবে। তবে আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) বিষয়টি এখনো জানা যাচ্ছে না। এই বিষয়টি সরকার, নির্বাচন কমিশন, বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ওপর নির্ভর করছে। তবে এ কথা ঠিক যে, দেশের এই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া খুব জরুরি। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে দেশে স্থিতিশীল রাজনীতিও দরকার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি সরকারে গেলে আন্দোলনে যারা ছিলেন, সেসব দল নিয়ে জাতীয় সরকার করা হবে-এটা দল থেকে আগেই বলা হয়েছে। নির্বাচনেও শরিকদের কিছু আসন ছাড় দেওয়া হবে। রাজনীতিতে গুণগত যে পরিবর্তন আসছে সেটি তারেক রহমানের বক্তব্যে বোঝা যায়। তারেক রহমান যে কথাগুলো বলছেন, তা ক্ষমতায় গেলেও বাস্তবায়ন করবেন।
তিনশ ফিট এলাকায় সংবর্ধনাস্থল পরিদর্শন : এদিকে তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের অনুমতি পেয়েছে দলটি। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান। সোমবার বিকালে রাজধানীর তিনশ ফিট এলাকায় নির্ধারিত সংবর্ধনাস্থল পরিদর্শন করেন বিএনপি নেতারা। সমাবেশ ঘিরে মঞ্চ প্রস্তুতের পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এলাকাজুড়ে মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি। পরিদর্শন শেষে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সাংবাদিকদের বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরাকে ঘিরে তাকে স্বাগত জানাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে বিএনপি। তিনি জানান, তার ফেরার দিনক্ষণকে কেন্দ্র করে বিএনপির পক্ষ থেকে আলাদা করে বিশাল জনসমাগমের কোনো আহ্বান জানানো হয়নি। তবে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি থাকবে বলে দলের প্রত্যাশা। মির্জা আব্বাস বলেন, তারেক রহমানের আগমন এখন দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। লাখো মানুষের আগমনের কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা না থাকলেও তারেক রহমান দেশে ফিরলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক। এর আগে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম জানান, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কোটি মানুষ তারেক রহমানকে স্বচক্ষে দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন।
১০ রুটে চলবে স্পেশাল ট্রেন : তারেক রহমানের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ঢাকায় যাতায়াতের উদ্দেশে বিশেষ ট্রেন বা অতিরিক্ত কোচ বরাদ্দের জন্য কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহ হতে আবেদন করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের যাতায়াতের জন্য ১০টি রুটে স্পেশাল ট্রেন পরিচালনা করার পাশাপাশি নিয়মিত চলাচলকারী একাধিক ট্রেনে অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করা হবে। এ কারণে স্বল্প দূরত্বের রাজবাড়ী কমিউটার (রাজবাড়ী-পোড়াদহ), ঢালারচর এক্সপ্রেস (পাবনা-রাজশাহী) এবং রোহনপুর কমিউটার (রোহনপুর-রাজশাহী) ট্রেনের ২৫ ডিসেম্বরের যাত্রা স্থগিত রাখা হবে। সোমবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এসব ট্রেনের এক দিনের যাত্রা স্থগিত করায় ওই রুটসমূহের যাত্রীদের সাময়িক অসুবিধার কারণে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, বিএনপি থেকে চাহিদা অনুযায়ী ট্রেন প্রদান নিশ্চিত করা হয়েছে। ১০টি ট্রেন থেকে প্রায় ৪০ লাখ টাকা আয় হবে রেলের। এসব বিশেষ ট্রেন কোনটা ঢাকা আসবে, আবার ঢাকা থেকে গন্তব্যে যাবে।
বুলেট প্রুফ বাসও দেশে এসেছে : নির্বাচনি কাজে ব্যবহারের জন্য বিএনপি’র কেনা বুলেট প্রুফ বাসও দেশে এসেছে। বাসটি রোববার চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হয়েছে। এটি দু-একদিনের মধ্যেই ঢাকায় পৌঁছাবে। এর আগে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যবহারের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন একটি ‘হার্ড জিপ’ গাড়ি দেশে পৌঁছে। টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো এলসি ২৫০ মডেলের এই গাড়িটি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ বিএনপি নামে নিবন্ধিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
