Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বার্ন ইনস্টিটিউটে আরও দুই শিশুর মৃত্যু

আইসিইউতে আছে ৯ জন

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বার্ন ইনস্টিটিউটে আরও দুই শিশুর মৃত্যু

বার্ন ইনস্টিটিউটে আরও দুই শিশু শিক্ষার্থী মারা গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ১৪ বছরের মাহতাব রহমান ভুইয়া ও বিকালে ১৫ বছরের মাহিয়ার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে মোট ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত দুই শিশুর স্বজনের বুকফাটা কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ আরও ভারী হয়ে ওঠে। 

এদিকে ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছে ৯ জন। যাদের শারীরিক অবস্থা চরম শঙ্কটাপন্ন। এ ছাড়া শঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে ১৮ জন। যাদের শরীরের ৩০ থেকে ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর প্রতিষ্ঠানটির ৫২ শিক্ষার্থীকে রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ইনস্টিটিউটে ৪২ জন ভর্তি আছে।

শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসায় ইতোমধ্যে চারটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বুধবার সিঙ্গাপুর থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ তিনজনের মেডিকেল টিম চিকিৎসাসেবা শুরু করেছে। শুক্রবার সকালের মধ্যে সিঙ্গাপুর ও চীন থেকে আরও দুটি চিকিৎসক টিম বার্ন ইনস্টিটিউটে আসছেন বলে জানিয়েছেন বার্ন ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক প্রফেসর ডা. মারুফুল ইসলাম। ডা. মারুফুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, চীন থেকে পাঁচ এবং সিঙ্গাপুর থেকে আরও তিনজন চিকিৎসক আসছেন। ভারত থেকে আসা তিনজনের চিকিৎসক টিম বৃহস্পতিবার হাসপাতালে এসেছে। 

গতকাল দুপুরে ছেলে মাহতাবের মৃত্যুর সংবাদ শুনে বাবা মিনহাজ আর্তচিৎকার শুরু করেন। ছেলেকে হারিয়ে তিনি বারবার জ্ঞান হারান। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল মাহতাব। সে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে মা-বাবার সঙ্গে থাকত। বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায়। বাবা মিনহাজ যুগান্তরকে বলেন, ‘সোমবারই আমার ছেলেকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। আমরা প্রার্থনা করছিলাম-ছেলের সুস্থতার জন্য। কিন্তু, আমার বাবাকে বাঁচানো গেল না। আমাদের শূন্য করে চলে গেল। সে ক্লাসের তৃতীয় ছিল, খুব মেধাবী। এ বয়সেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। রোজা রাখত। এখন আমরা কী নিয়ে বাঁচব’-বলেই বিলাপ করতে শুরু করেন মিনহাজ। 

এদিকে বিকাল পৌনে ৫টার দিকে আইসিইউতে মারা যান শিক্ষার্থী মাহিয়া (১৫)। বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, ‘মাহিয়ার শরীরের প্রায় ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু বিকালের দিকে সে মারা যায়।’ মাহিয়ার মা আফরোজা বেগমসহ স্বজনদের আর্তনাতে হাসপাতাল ভারী হয়ে উঠছে। পাশে থাকা অন্য স্বজনরা (যাদের সন্তান আইসিইউতে ভর্তি) বিলাপ করছেন। জানা যায়, মাহিয়া মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। তারা তিন বোন ছিল, মাহিয়া ছিল মেজ। পাঁচ বছর আগে তার বাবা মারা যায়। বর্তমানে তারা উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে থাকে। মাহিয়ার পরিবারের অভিযোগ, সকাল ৮টা থেকে তাদের ক্লাস শুরু হয়। দুপুর ১টায় শেষ হয়। এই মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ জোর করে শিশুদের আটকে রাখে কোচিং করানোর জন্য। তারা শিশুদের খাঁচায় আটকে রাখে। বাধ্য করা হয় কোচিং করতে। যদি ১টায় তারা বের হতে পারত, তাহলে হয়তো বেঁচে যেত। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, বার্ন ইনস্টিটিউটে বিশ্বমানের চিকিৎসক রয়েছে-বিদেশ থেকে আসা চিকিৎসক টিমের সঙ্গে কাজ করছেন দেশের বার্ন চিকিৎসকরা। এমন পরিস্থিতিতেও স্বজনদের মধ্যে উৎকণ্ঠা উদ্বেগ পিছু ছাড়ছে না। এক এক করে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভর্তিকৃত বেশির ভাগের শরীর ৩০ থেকে ৯৫ শতাংশ পোড়া। ফলে কাউকেই পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার দিনভর বার্ন ইনস্টিটিউটে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দুর্ঘটনার চার দিন পরও বার্ন ইনস্টিটিউট ঘিরে সাধারণ মানুষের ভিড়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রক্ত দিতে আসছেন সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া দগ্ধ ব্যক্তিদের আত্মীয়পরিজন বার্ন ইনস্টিটিউটের এক একটি ফ্লোরের বারান্দায় আর্তনাত করছেন। আইসিইউ থেকে যখন এক একটি লাশ বের হচ্ছে-তখনই স্বজনরা আর্তচিৎকার শুরু করেন। হাসপাতাল ঘিরে স্বজন হারাদের আর্তচিৎকারে পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না। আইসিইউ ও এইচডিইউতে থাকা দগ্ধ শিশুদের প্রাণ থাকলেও ওরা একেবারেই নীরব। যেসব শিশু খানিকটা সময় পেলেই আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত, তাদের এখন সারা নেই। এদের মা বাবা স্বজনরা টানা প্রার্থনা করছেন। চিকিৎসক নার্স সরকারের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন যেকোনো মূল্যে তাদের সন্তানদের সুস্থ করে তোলা হয়। দেশি বিদেশি চিকিৎসকদের শত চেষ্টার পরও এক এক করে শিশুরা মারা যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীদের ৩০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলে প্রায় সবাই শঙ্কায় থাকে। ভর্তি শিশুদের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ শিশুর শরীর ২০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। অনেক শিশুকে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে ভর্তি করানো হয়েছে। 

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের চিকিৎসক নার্সসহ পুরো স্টাফ দিন রাত কাজ করছেন। বিদেশ থেকে আসা চিকিৎসকদের সঙ্গে এক এক করে প্রতিটি দগ্ধ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা চলছে। উভয়ের মধ্যে চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এর আগে এত বেশি দগ্ধ শিশু ইনস্টিটিউটে আসেনি। চারজন শিক্ষক ছাড়া সবাই শিশু, যাদের বয়স ১৪ বছরের মধ্যে। দগ্ধদের যাবতীয় চিকিৎসা খরচ সরকার বহন করছে। আমাদের পক্ষ থেকে যাবতীয় ওষুধ বিনামূলে দেওয়া হচ্ছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও অনেক শিশুকে বাঁচানো যাচ্ছে না। আমরা দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই যাতে এসব শিশুদের সুস্থ করে তুলতে পারি। 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের শোক মিছিল : বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে শোক মিছিল করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখা। মিছিল শেষে বক্তারা বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমরা প্রত্যাশা করি, আহতদের চিকিৎসায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতিটি রোগীর সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে, যেন তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।’

এ ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর কখনো না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে কার্যকর ও দূরদর্শী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তারা। শোক মিছিলে উপস্থিত ছিলেন-বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম সম্পাদক সীমা মোসলেম, ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রেহানা ইউনুস। 

মাহেরীন চৌধুরীর সমাধিতে বিমানবাহিনীর শ্রদ্ধা : নীলফামারী প্রতিনিধি জানায়, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাহসী শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। বুধবার রাতে নীলফামারীর জলঢাকা সদরের বগুলাগাড়ী গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিমানবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল। তারা বিমানবাহিনীর এয়ার চিফ মার্শাল হাসান খানের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। প্রতিনিধিদল মাহেরীনের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়- মানবিকতা, সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। নিজের জীবন উৎসর্গ করে তিনি যেভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন, তা চিরকাল জাতির হৃদয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


ঘটনাপ্রবাহ: উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম