মলাট বৃত্তান্ত
জাল সনদের জ্বালা!
কী ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? * যে দেশে শিক্ষকের সনদ জাল, সে দেশে তুমি কতটুকু খাঁটি তাই ভাবছি!
শফিক হাসান
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তোবাররিক মকরুক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। সম্প্রতি তার রাগ করার মতো কাণ্ড ঘটে গেছে। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) শনাক্ত করেছে ১১৭২ জন জাল সনদধারী শিক্ষক। এর মধ্যে তিনিও একজন। জাল-নবিশ সব শিক্ষকের প্রতিনিধি হিসাবে তোবাররিক মকরুকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিচ্ছু। জাল-নবিশ এ শিক্ষক প্রতিনিধি উল্লেখ করেছেন তার ও তাদের হৃৎচেরা অন্তর্কথন। বাতচিতে সঙ্গে ছিলেন শফিক হাসান
* স্যার, কেমন আছেন?
** আমাকে ‘স্যার’ ডেকে কি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছেন? স্যার তো আপনারা, যাদের সনদপত্র কলঙ্কমুক্ত। পত্রিকার খবরে কী লিখেছেন শোনেন তাহলে-‘...সবচেয়ে বেশি জাল সনদধারী শিক্ষক পাওয়া গেছে রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে। এ বিভাগে ৭৭৯ জন জাল সনদধারী শিক্ষক শনাক্ত হয়েছে।’ সব জাল কি আমরাই করেছি! আর আপনারা সবাই পূতপবিত্র?
* ‘ধরিয়ে দেওয়ার’ বিরুদ্ধে আপনারা কি বৃহত্তর কোনো আন্দোলনে যেতে চান?
** শাটডাউন নিলডাউন ওসব পরের চিন্তা। তার আগে আমাকে বলুন-যারা অন্যের ছিদ্রান্বেষণে নিয়োজিত তারা কি জাল সনদ জ্বাল দিয়ে চা খাবেন? জাল লিখতেও কিন্তু তিন রকমের প্যাঁচ আছে। জাল, জ্বাল, ঝাল। কেন, সব মিলিয়ে একটা শব্দ হতে পারত না? তিনটা অক্ষর জ, ঝ, য-এর কী দরকার ছিল? আবার দেখুন শ-ও কিন্তু তিনটা। শ, স, ষ। কোন পণ্ডিতে এত কারিগরি দেখিয়েছেন, অহেতুক জটিল করে তুলেছেন পাঠ্যবইকে?
* আপনার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলি-চা কিন্তু খায় না, পান করে। শিক্ষক হয়ে ভাষার বিকৃতি ঘটাতে পারেন না!
** আপনি দেখছি আরও বড় পণ্ডিত, তালেবর! ‘পান করে’ বললে পেটের ভেতরে যায়, আর ‘খায়’ বললে কি গলায় আটকে থাকে? যে পন্থাতেই যাক, পেটে পড়লেই হলো। খায় বলাটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আপনি যে পান-সুপারির গল্প শোনালেন ওই ভাষায় কেউই কথা বলে না। চাইলে বাজি ধরতে পারেন।
* ছাত্রজীবন নিশ্চয়ই মধুর ছিল?
** না, জনাব। ‘কদুর’ ছিল। এত বইও মানুষ পড়ে? বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান থেকে শাখা-প্রশাখা মেলতে মেলতে কতদিকে যে চলে গেল। প্রাইমারিটাই ভালো ছিল। একবার পড়া পারিনি বলে বদ বদরুল স্যার আমাকে মেরেছিলেন। আমিও কি অত সহজ ছাত্র? বদরুল মাস্টারের হাতের বেত কেড়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। আর কখনো স্কুলের বারান্দা মাড়াইনি।
* তাহলে এসএসসি পাস করলেন কীভাবে? নাকি ওই সনদটাও বিশেষভাবে বানানো?
** ঝিয়ারি হয়ে ননদ সাজতে আসেন কেন? মুখ সামলে কথা বলবেন। আগে তো শুনবেন, তারপর মন্তব্য। ওই সময় অনেক বুদ্ধিমান ছাত্রই অভিভাবকদের সহায়তায় উচ্চশিক্ষার্থে গ্রামযাত্রা করত। পরীক্ষার আগে আমরা শহর থেকে দলেবলে গ্রামে চলে যেতাম। সেখানে নকল করে বা পাশের ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে দেখে লেখার সুযোগ ছিল। তখনকার শিক্ষকরাও ভালো ছিলেন। যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। পাস করে মিষ্টি বিলানোর সময় তাদেরও আনন্দের অংশীদার করে নিতাম।
* নকল বন্ধ হয়েছে বলেই কি প্রকৃত মেধাবীদের সাক্ষাৎ মিলছে না?
** শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে অনেক আগেই। আমরাই ছিলাম মেধাবীদের মধ্যে সর্বশেষ ব্যাচ। যারা জানতাম টুকলিফাইংয়ের মূল মানে। এখনকার শিক্ষার্থীরা ম্যাগনিফাইং চেনে, টুকলিফাইং বোঝে না। সমস্যা থাকলে সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। ক্লাসমুখী একজন শিক্ষক হিসাবে আমার পরামর্শ-বছর বছর সবাইকে অটোপাস দিয়ে ওপরের ক্লাসে তুলে দিক সরকার। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে বোধকরি কারওই ভালো লাগে না। এরচেয়ে ভালো কাজে সময়টা ব্যয় করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
* সমাধান কি তাহলে এটাই?
** আমাদের দরকার ‘অস্থির, জটিল’ একটা শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীরা সারাদিন ইউটিউব দেখে, মোবাইল ফোনে প্রেম-প্যাঁচাল পেড়েও যেন পাস করতে পারে। পাস করার নিশ্চয়তা থাকলে কেউই নীলক্ষেত বা লালক্ষেতে গিয়ে নকল সনদ বানাবে না। গোড়ায় যে গলদ আছে, সেটা আগে সারান। তারপর আমাদের অভিযুক্ত করতে আসবেন। পারেন তো কেবল নিরীহদের সঙ্গে বাহাদুরি ফলাতে।
* তার মানে কৃতকর্মের জন্য আপনি বা আপনারা
অনুতপ্ত নন?
** ঘোর শীতকালেই যেখানে শীত নেই, তপ্ত-ই তো আছি। অনুতপ্ত কী জিনিস, ভাই? অন্যদের কথা জানি না। আমি পরিস্থিতির শিকার, আগেই বলেছি। খারাপ ছাত্র হতেই পারি, তাই বলে বদরুল স্যার আমাকে মারবেন কেন? আর শিক্ষাব্যবস্থাইবা এতগুলো বই চাপিয়ে দিল কেন? প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে কি আমরা পড়ার সময়-সুযোগ পেতাম?
* শেষ কথা হিসাবে কী বলতে চান?
** জাল সনদ অনেকেরই আছে, ধরা পড়ি আমরা। যেহেতু মানুষ গড়ার কারিগর, অমানুষ নই। অন্যদের কথা বাদ দেন। আপনার সাংবাদিকতা ক্ষেত্রের কী অবস্থা? সবাই কি সাংবাদিকতা পড়ে এসেছে! ধন্যবাদ, সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। আপনার সম্পাদককে বলবেন-আমার ছবিটা যেন বড় করে ছাপে।
