Logo
Logo
×

বিচ্ছু

রম্যগল্প

কবিতা পাঠের আসর

Icon

মোহাম্মদ কামরুজ্জামান

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলো এসে অনেকের ঘরোয়া কথাই আজকাল সাহিত্য হয়ে উঠছে। কথায় একটু নন্দনপ্রয়াস করে কোনোমতে সাহিত্যতুল্য করে ফেলছেন। ঘরে ঘরে সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে। অনেকে সফলও হচ্ছেন-অনলাইন বন্ধুদের কাছে কবি, গল্পকার, আঁকিয়ে বলে বেশ খ্যাতি জুটিয়ে ফেলেছেন। কিছুদিন ওভাবে সম্বোধন পাবার পর সাহিত্যিক অভিমান তৈরি হচ্ছে। সেটা আঁচ করতে পেরে অন্যরা আবার ওদেরকে একেবারে ছেড়ে দিচ্ছে না, সুযোগ পেলেই কথার আঁচড়ে ছড়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে, এ দিকে যারা অনেকের থেকে একটু বেশিদূর এগিয়েছেন, তাদের অভিমানটা বেশি জমেছে বলে, সুযোগ পেলেই অন্যদের মানসম্মান নিয়ে টান দিয়ে দিচ্ছেন।

একবার এক সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে হাসনান মোগছেদপুর নামে এক ভদ্রলোক একটা পোস্ট দিয়ে কটাদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। লোকজন এত যে কমেন্ট করছে, তার কোনো রা নেই। ওই রকম একটা দুটো কথা আমাকে বললে আমার শিড়দাঁড়া নড়ে উঠত। আর উনি কিনা দিব্যি হজম করে যাচ্ছেন। দিন দশেক পরে লোকটার খোঁজ মিলল। শেষ কমেন্টটির নিচে তার জবাব পড়ে বুঝলাম, শেষতক ওনার টনক নড়েছে। টনক তো নড়বারই কথা। শেষ কমেন্টটি ছিল বেশ শ্লেষাত্মক-‘ঠিকমতো বানান করে বাংলা লিখতে না জেনেও আজকাল অনেকে কবিখ্যাতি পেতে মরিয়া হয়ে গেছেন।...আহারে, কবিতা কি এতই সোজা!’ হাসনান সাহেবের জবাব ছিল, ‘বিশ্বাস করেন, এটা কবিতা নয়। দিন দশেকের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি, নিরিবিলি কোথাও কাটিয়ে আসব, মোবাইল ফোনটাও সাথে থাকবে না, তাই সবাইকে সেটা জানিয়ে যাচ্ছিলাম। আর লাইনগুলো যে ছোট ছোট করেছি, সেটা সকলের পাঠসুবিধার জন্য, অনেকটা দৈনিক পত্রিকায় কলামে কলামে ভাগ করে টেক্সট সাজানোর সুবিধা মাথায় রেখে। ভুল হয়েছে যে শুরুর লাইনটা একটু বেশি ছোট হয়ে গিয়েছিল-ছুটি। আসলে ‘ছুটি’ বলে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছিলাম, আর সেইসাথে পোস্টের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে ধারণা দিতে চেয়েছিলাম-যেটাকে আপনারা কবিতার নাম বলে ধরে নিয়েছেন। আমি জীবনে কখনো কবিতা লিখিনি, আমার বংশে কেউ লিখেছে, এমনও শুনিনি। আমি একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করি, ভাই। বিকেলে সংসদ ভবনের সামনে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকি। কোনো কোনো দিন ফুচকা-চটপটি খাই, কোনো কোনো দিন বাদাম। রুমমেটরা ধরেপড়ে নিয়ে গেলে, কোনো কোনো বন্ধের দিন আনন্দ সিনেমা হলে সিনেমা দেখি। সন্ধ্যায় নাখালপাড়ায় মেসে ফিরে আসি। বিছানার পরে বসে বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলি, অথবা মেসের অফিসরুমে বসে বসে টিভি দেখি। কোনো গার্লফ্রেন্ডও নাই যে কখনো রোমান্স উছলে উঠে বাক্যালাপে বেরোবে-আর তার দু’য়েকটা কস্মিনকালে কবিতা হয়ে যাবে। সকালে অফিস যেতে হবে ভেবে লুঙ্গির কোঁচে হাত রেখে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। আজ আপনাদের কাব্যসমালোচনার তোড়ে সত্যিই কবি হয়ে গেলাম। কিন্তু তাতে কোনো আনন্দ পাচ্ছি না। যা হতে চাইনি, তা হয়ে আনন্দ কোথায়? তবে বড্ড কৌতুক হচ্ছে। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে এতগুলো হিংসুটে লোক আছে, তা ভেবেই বেদম হাসি পাচ্ছে...’ এটুকু পড়েই ঢাকার বাঘা বাঘা কবিরা বুঝলেন, এ যাত্রায় ফেঁসে গেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া সাইট আর লিটলম্যাগের কল্যাণে তাদেরকে সবাই চেনে। দু’একজনের কবিতা দৈনিকের সাহিত্য পাতায়ও প্রকাশ পায়। বোদ্ধা কবি হিসাবে তাদেরকে মানুষ সমীহ করে চলে। কাব্যপাঠের আসরে তাদের কাউকে ডাক না দিলে, সেদিন আর কারোর কবিতাই কেউ শুনতে পায় না, হয় মাউথপিচের তার কাটা থাকে, নয় পাশেই হকারসমিতির মাসিক সভা চলে।

পরের দিন সকাল বেলা উঠেই দেখি হাসনান সাহেবের পোস্ট থেকে সব কমেন্ট হাওয়া হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরে পোস্টটাও হাওয়া। ঢাকার বাঘা বাঘা কবিদের কারা কী আঁচড় কেটেছিলেন, তার সব আর জানা গেল না। একটা স্ক্রিনশট নিয়ে রাখলে বেশ কাজে দিত। খুব কৌতূহল হচ্ছিল। বড্ড ভুল হয়ে গেল। তবে বাঘা বাঘা কবিরা বোধহয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। লোকজন জানার আগেই, ওদের কীর্তি মুছে গেছে। তবে আমার কৌতূহল মিটল না, বিকেলে সেটা কৌতুকে রূপ নিল, যখন দেখলাম, ‘প্রচারে এলাকাবাসী’ নামে এক অপরিচিত তার সদ্য খোলা অ্যাকাউন্টে হাসনান সাহেবের পোস্ট এবং সেসব বাঘা বাঘা কবিদের সব কমেন্টের পরিষ্কার স্ক্রিনশট পোস্ট করলেন। কমেন্টের পর কমেন্ট পড়তে থাকল-সুশীল সমাজের।

তারপর থেকে কাব্যপাঠের আসরে, মাইকের উৎপাদ বন্ধ, মাউথপিচ হাতে নিয়ে মুখে শব্দ করলেই জলতরঙ্গের মতো পরিষ্কার কবিতার নিক্বণ ভেসে যায়। এক দঙ্গল কবি কাব্যপাঠ করার জন্য কবিতা নিয়ে হুলস্থ’ল করে না, কেবল আমন্ত্রিত কবিরাই ধীরে-সুস্থে কবিতা পড়ে যান। কনকর্ড এম্পোরিয়ামের সামনের খোলা জায়গাটাতে বসে চা-সিঙ্গাড়া খেতে খেতে দর্শক-শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে কবিতা শুনে সন্ধ্যেটা পার করে ঘরে ফেরেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম