মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রদূত সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ.)
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে যেসব আন্দোলন মুসলিম সমাজকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল, তার মধ্যে অন্যতম সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত তৌহিদভিত্তিক সংস্কার ও জিহাদি আন্দোলন। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অন্ধকারে এক আলোকবর্তিকা।
তার লক্ষ্য ছিল, ইসলামের বিশুদ্ধ আদর্শ ফিরিয়ে আনা, শিরক-বেদাত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুসলমানদের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধার করা।
তখন উপমহাদেশে মুসলিম সমাজ গভীর ধর্মীয় অবক্ষয়ের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব, পীর পূজা, কবর পূজা, বেদাত ও শিরক-এসব কুসংস্কার মুসলমানদের ইমান ও আমলের ভিত দুর্বল করে ফেলেছিল। মুসলমানদের রাজনৈতিক শক্তিও ভেঙে পড়ে। এ অন্ধকার সময়ে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.) ও তার প্রিয় সহচর সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী (রহ.) এক বিশুদ্ধ তাওহিদের দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়লেন।
সাইয়েদ আহমদ (রহ.) বিশ্বাস করতেন-বিশুদ্ধ তাওহিদ ও নবীজির সুন্নাহকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া মুসলিম সমাজের প্রকৃত উন্নতি ও পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। তিনি ঘোষণা দেন : ‘ইসলামের নাম রেখে মুশরিকি আচরণ করা যাবে না; আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি শুধু মুখে নয়, জীবনের প্রতিটি কাজে প্রকাশ পেতে হবে।’
১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের রায়বেরেলিতে জন্মগ্রহণকারী সাইয়েদ আহমদ (রহ.) শৈশব থেকেই ধর্মীয় শিক্ষায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি শাহ আবদুল আজিজ দেহলভী (রহ.) এর সান্নিধ্যে এসে ইসলামের সংস্কারবাদী ধারার সঙ্গে যুক্ত হন।
১৮২১ সালে তিনি হজব্রত পালনের উদ্দেশে মক্কায় যান। সেখান থেকে ফিরে এসে ইসলামি পুনর্জাগরণের স্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করেন। তিনি সব জায়গায় প্রচার করতে থাকেন যে, মুসলমানদের ইমানকে বিশুদ্ধ করা ও সমাজে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা ফরজ।
তার সংস্কার আন্দোলন শুধু ধর্মীয় সীমায় আবদ্ধ ছিল না; বরং তা রাজনৈতিক ও সামরিক রূপও নেয়। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও শিখ শাসনের নিপীড়নে মুসলমানরা যখন অসহায়, তখন তিনি তাদের জাগিয়ে তুলতে আহ্বান জানান। পাঞ্জাব ও সীমান্ত অঞ্চলের মুসলমানদের সংগঠিত করে গঠন করেন ‘মুজাহিদ বাহিনী’ নামক একটি তাওহিদপ্রাণ ইসলামি বিপ্লবী দল।
এ জিহাদি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল-একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে কুরআন ও সুন্নাহ হবে শাসনের ভিত্তি। ১৮২৬ সালে তিনি হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে পশতু অঞ্চলে চলে যান এবং বালাকোটকে কেন্দ্র করে জিহাদের ঘাঁটি স্থাপন করেন। তাকে ‘ইমামুল মুজাহিদিন’ বলা হয়।
সাইয়েদ আহমদ শহীদের আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন তার সঙ্গী ও শিষ্য শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.)। ইসমাঈল (রহ.) ইসলামি চিন্তায় এক বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার প্রতিনিধি ছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তাকউইয়াতুল ইমান’ মুসলমানদের হৃদয়ে তাওহিদের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। উভয়ে মিলিত হয়ে মুসলমানদের ইমান সংশোধনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার আন্দোলনও পরিচালনা করেন।
তাদের এ সংগ্রাম ছিল শুধু রাজনৈতিক নয়-এটি ছিল ইমানের সংগ্রাম, আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম এবং আল্লাহর পথে আত্মত্যাগের দাওয়াত।
১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের যুদ্ধ ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। সেদিন সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.) ও শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.) শত শত সহযোদ্ধাসহ শিখ বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে শাহাদতবরণ করেন। তাদের রক্তে সিঞ্চিত হয় উপমহাদেশের ইসলামি আন্দোলনের মাটি।
যদিও তাদের জিহাদ সামরিকভাবে সফল হয়নি, কিন্তু চিন্তার মঞ্চে তারা স্থায়ী বিজয় অর্জন করেন। তাদের রেখে যাওয়া তাওহিদভিত্তিক চেতনা পরবর্তী সময়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারায় নবজীবন পায় এবং পরোক্ষে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা, তাবলিগ জামাতের দাওয়াতি ধারা ও অন্যান্য সংস্কার আন্দোলনের বীজ বপন করে যায়।
সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি ছিল চারটি স্তম্ভের ওপর-বিশুদ্ধ তাওহিদ : আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে সাহায্য না চাওয়া, পীর পূজা ও কবর পূজা ত্যাগ। সুন্নাহর অনুসরণ : নবীজির জীবনধারাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা। বেদাত পরিত্যাগ : ধর্মে নতুন সংযোজন বা বিকৃতি থেকে বিরত থাকা। শরিয়াহভিত্তিক সমাজব্যবস্থা : মুসলিম সমাজকে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে পরিচালনা করা। এ দর্শন পরবর্তীকালে ‘ওয়ালিউল্লাহি চিন্তাধারা’ হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
সাইয়েদ আহমদ শহীদের আন্দোলন উপমহাদেশে মুসলিম আত্মপরিচয়ের পুনর্গঠন করে। তার অনুসারীরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মীয় সংস্কার ও আত্মশুদ্ধির দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়। তার চিন্তা ও রক্তজোয়ার থেকেই দারুল উলুম দেওবন্দের আলেমরা অনুপ্রাণিত হন ব্রিটিশবিরোধী ফতোয়া দিতে। মাওলানা শিবলী নোমানি, মওলানা আবুল কালাম আজাদসহ পরবর্তী মুসলিম চিন্তাবিদরা তার আন্দোলনের আদর্শকে বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে বিকশিত করেন।
তিনি প্রমাণ করে গেছেন, দাওয়াত, সংস্কার ও জিহাদ একে অপরের পরিপূরক। সমাজ পরিবর্তনের জন্য শুধু ধর্মীয় প্রচার নয়, প্রয়োজনে আত্মত্যাগও জরুরি।
সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ.) ছিলেন একজন সংস্কারক, মুজাহিদ এবং আত্মনিবেদিত দাঈ। তিনি শুধু অস্ত্র হাতে লড়াই করেননি; বরং মানুষের মন থেকে শিরক-বেদাতের জং দূর করতে কলম ও কথার জিহাদও চালিয়েছেন। তার শাহাদত ইসলামি ইতিহাসে এক অনন্ত অনুপ্রেরণার নাম।
আজ যখন মুসলিম সমাজ আবারও বিভ্রান্তি, ভোগবাদ ও আত্মবিস্মৃতির ঘূর্ণিতে আবদ্ধ, তখন সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর তাওহিদভিত্তিক আন্দোলন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-‘সংস্কার শুরু হয় আত্মশুদ্ধি থেকে, আর মুক্তি আসে তাওহিদের পথে ফিরে গেলে।’

