Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

অন্ধকারে আলোর দিশারি মুজাদ্দিদে আলফে সানি

তোফায়েল গাজালি

তোফায়েল গাজালি

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অন্ধকারে আলোর দিশারি মুজাদ্দিদে আলফে সানি

সত্য যখন ম্লান হয়ে যায়। ন্যায় যখন পরাভূত হয়। আকাশ তখন আর নীরব থাকে না। খোদাতায়ালা তখনই পৃথিবীতে প্রেরণ করেন মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। যিনি নবীর দ্বীনকে নতুন করে জীবন্ত করে তোলেন। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি এই উম্মতের দ্বীনকে সংস্কার করবেন। (আবু দাউদ-৪২৯১)।

নবুয়তের প্রতিশ্রুতিরই এক উজ্জ্বল প্রতিফলন ছিলেন ইমাম রাব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে সানি, শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.)। যিনি অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজে তাওহিদের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে সম্রাট আকবর যখন ভারতবর্ষে দ্বীনে ইলাহি নামের এক বিকৃত ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে ইসলামকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিলেন, তখন এই সাহসী আলেম তাওহিদের মশাল হাতে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।

মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) ইতিহাসে যেমন এক শক্তিশালী রাজা হিসাবে পরিচিত, তেমনি ধর্মীয় উদ্ভটতার জন্যও কুখ্যাত। তার রাজসভা ছিল এক ধর্মসংলাপের অঙ্গন, যেখানে হিন্দু, জোরোয়াস্ত্রীয়, খ্রিষ্টান ও মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতরা মতবিনিময় করতেন। প্রথমদিকে এটি ছিল মুক্তচিন্তার একটি উদ্যোগ, কিন্তু ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় এক বিকৃত মতবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে।

আবুল ফজল ও ফয়েজির মতো রাজপণ্ডিতরা আকবরকে প্ররোচিত করেন একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠায়, যার নাম রাখা হয় দ্বীনে ইলাহি (ঈশ্বরপ্রদত্ত ধর্ম)। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি, কিন্তু এতে ইসলামের মৌলিক বিধান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নবীজি (সা.)-এর চূড়ান্ত নবুয়তকে অস্বীকার, নামাজ, রোজা, হজকে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা এবং আকবরকে আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে পূজা, এসবই ছিল দ্বীনে ইলাহির অনুসঙ্গ।

এ বিকৃতি ইসলামি সমাজে গভীর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। অনেক আলেম ওলামাও তখন রুটি-রুজির ভয়ে নীরব হয়ে যান। কেউ কেউ আপস করে ফেলেন। এমন এক অন্ধকার সময়ে একজন তরুণ আলেম নির্ভীক কণ্ঠে গর্জে উঠলেন-‘যে ধর্মে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য নেই, সে ধর্ম আল্লাহর ধর্ম হতে পারে না।’ এই তরুণই ছিলেন শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.)। পরবর্তীকালে যিনি ইতিহাসে খ্যাত হন ‘মুজাদ্দিদে আলফে সানি’ নামে।

শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন ১৫৬৪ইং সনে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের সিরহিন্দ নগরে। তার বাবা ছিলেন নকশবন্দি তরিকার একজন বিখ্যাত সুফি শায়খ আব্দুল আহাদ ফারুকী (রহ.)। বংশপরিচয়ে তিনি দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর বংশধর।

শায়খ আহমদ ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ মেধাবী ছিলেন। তিনি কুরআন ও হাদিস মুখস্থ করার পাশাপাশি ফিকহ, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও তাসাউফে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। কৈশোরে দিল্লি, আগ্রা ও সামরকন্দের পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি জ্ঞানের যে গভীরতা অর্জন করেন, তা পরবর্তীতে তার চিন্তার ভিত্তি হয়ে ওঠে।

আকবরের ধর্মীয় নীতির বিকৃতির ফলে মুসলিম সমাজে এক ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। রাজসভায় ইসলামবিরোধী মতবাদ প্রচার পেতে থাকে, মসজিদে নামাজ বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি ‘আল্লাহু আকবর’-এর পরিবর্তে ‘জয় আকবর’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়।

এ পরিস্থিতিতে শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) কলম হাতে তুলে নেন। তিনি শুরু করেন তার বিখ্যাত ‘মাকতুবাতে ইমাম রাব্বানী’ চিঠির মাধ্যমে দাওয়াতের এক বিপ্লব। এসব চিঠি তিনি পাঠান প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আলেম, সুফি ও সাধারণ মুসলমানদের কাছে। এতে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন-

‘নবীজির (সা.) শরিয়তই মানবতার একমাত্র পথ। আকবরের উদ্ভাবিত দ্বীনে ইলাহি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’

তার যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা, কুরআন ও হাদিসনির্ভর বিশ্লেষণ, সব মিলিয়ে ইসলামি সমাজে এক নবজাগরণের ঢেউ তোলে। ধীরে ধীরে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি দ্বীনে ইলাহি ত্যাগ করে আবার ইসলামে ফিরে আসেন।

আকবরের মৃত্যুর পর ১৬০৫ সালে সিংহাসনে বসেন তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর। প্রথমদিকে জাহাঙ্গীর বাবার নীতি অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। রাজদরবারে উপস্থিত কয়েকজন চাটুকার আলেম ও সুফি মুজাদ্দিদে আলফে সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন-তিনি বিদ্রোহ উসকে দিচ্ছেন, রাজদরবারের নীতি অমান্য করছেন।

ফলে ১৬১৮ সালে তাকে গ্রেফতার করে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি করা হয়। প্রায় এক বছর তিনি সেখানে কারাবন্দি ছিলেন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, বন্দিত্বেও তার দাওয়াত বন্ধ হয়নি। পাহারাদার সৈনিকরা তার আচার-আচরণ, চরিত্র ও ইমানের দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

অবশেষে জাহাঙ্গীর নিজেই তার আধ্যাত্মিক মহত্ত্বে প্রভাবিত হয়ে তাকে মুক্তি দেন এবং রাজসভায় মর্যাদার আসনে বসান। জাহাঙ্গীরের পরবর্তী শাসনকালেই ইসলামি চেতনা নতুন করে জেগে ওঠে, যা শায়খ আহমদের ত্যাগ ও ধৈর্যের ফল।

শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.)কে বলা হয় ‘মুজাদ্দিদে আলফে সানি’ অর্থাৎ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক। হিজরি এক হাজার বছর পূর্তির সময় তিনি যে ইসলামি সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন, তা ইসলামি চিন্তার ধারাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে।

তিনি শুধু রাজনীতি নিয়ে কথা বলেননি; বরং ইসলামি চিন্তা, তাসাউফ, নৈতিকতা ও সমাজ সংস্কারে এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন। তার চিন্তা শরিয়ত ও তাসাউফের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে, যা পরে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.)সহ বহু আলেম, দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মাধ্যমে আরও বিকশিত হয়।

শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) সুফিবাদের এক বিশুদ্ধ রূপ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলতেন, ‘যে তাসাউফ শরিয়তবিহীন, তা ভ্রান্ত; আর যে শরিয়ত তাসাউফবিহীন, তা নিষ্প্রাণ।’

তিনি তাওহিদের ধারণায় ‘তাওহিদে শুহুদি’ মতবাদ তুলে ধরেন, যেখানে মানুষ সৃষ্ট জগতে আল্লাহর উপস্থিতি উপলব্ধি করে, কিন্তু স্রষ্টা ও সৃষ্টি একীভূত নয়। এ ধারণা ইসলামি দর্শনের এক গভীর ব্যাখ্যা, যা পরবর্তী সময়ে মুসলিম চিন্তা জগতে নতুন প্রাণসঞ্চার করে।

মুজাদ্দিদে আলফে সানির আন্দোলন ও দাওয়াত ভারতবর্ষে এক দীর্ঘস্থায়ী ইসলামি নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটায়। তার ছাত্র ও অনুসারীরা বিভিন্ন স্থানে ইসলামি শিক্ষা, নৈতিক শুদ্ধতা ও রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেন।

পরবর্তী সময়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.), সৈয়দ আহমদ বেরেলভী (রহ.)সহ অগণিত ইসলামি আন্দোলনপ্রধান তার চিন্তা ও অনুপ্রেরণার উত্তরাধিকার বহন করেন। ইসলামি সমাজে দ্বীনে ইলাহি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় এবং ইসলাম তার আসল মর্যাদায় ফিরে আসে।

মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) আমাদের শেখান, সত্যের পথে দাঁড়াতে গেলে আপস নয়, ত্যাগের সাহস লাগে। তিনি দেখিয়েছেন, কলমের শক্তি তরবারির চেয়েও প্রভাবশালী হতে পারে, যদি সেটি ইমান ও জ্ঞানের আলোকিত পথে পরিচালিত হয়।

আজকের যুগেও যখন ধর্মের নামে বিভ্রান্তি, কুসংস্কার ও রাজনীতির অপব্যবহার দেখা যায়, তখন শায়খ আহমদ সিরহিন্দির সংগ্রামী জীবন আমাদের ডাকে সত্যের পথে।

তার মুখের সেই আহ্বান আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে, ‘আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর আনুগত্যই মুক্তির পথ; আর যিনি এ পথ থেকে বিচ্যুত, সে যত শক্তিশালীই হোক, সে পরাজিত।’

লেখক : ধর্মীয় গবেষক ও গণমাধ্যম কর্মী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম