Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ওয়াজ মাহফিলে অপ্রয়োজনীয় মাইক ইবাদত নয় জনদুর্ভোগ

Icon

মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ওয়াজ মাহফিলে অপ্রয়োজনীয় মাইক ইবাদত নয় জনদুর্ভোগ

ফাইল ছবি

বর্তমানে ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে মাইক ও লাউড স্পিকারের অপব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। অনেক সময় দাওয়াতের নামে এমন উচ্চ শব্দে বক্তব্য প্রচার করা হয়, যা আশপাশের মানুষের জন্য বিরক্তি ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে শুধু ইবাদতের পরিবেশ ব্যাহত হয় না, বরং ইসলামের দয়া, সহনশীলতা ও মানবিকতার শিক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে একজন অসুস্থ ব্যক্তি, বৃদ্ধ, পরীক্ষার্থী, ঘুমন্ত শিশু বা বিশ্রামরত মানুষেরও স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। এসব অধিকার লঙ্ঘন করে যদি দাওয়াত দেওয়া হয়, তবে তা ইসলামের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। ইসলাম কখনোই চায় না, আল্লাহর নাম উচ্চারিত হবে মানুষের কষ্টের বিনিময়ে।

ওয়াজ মাহফিল নিঃসন্দেহে দ্বীন প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তবে তা তখনই কল্যাণকর হয়, যখন দাওয়াত দেওয়া হয় শালীনতা, সংযম ও প্রজ্ঞার সঙ্গে। প্রযুক্তি আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত; কিন্তু সীমা অতিক্রম করলে সেই নিয়ামতই পরীক্ষায় পরিণত হয়।

মাইক ব্যবহার : ইবাদত নয়, একটি উপকরণ

মাইক বা লাউড স্পিকার কোনো ইবাদত নয়; বরং এটি একটি সহায়ক উপকরণ মাত্র। শরিয়তে কোথাও নামাজ, খুতবা বা ওয়াজের জন্য মাইক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কাজেই এর ব্যবহার হবে প্রয়োজন অনুযায়ী অতিরিক্ত নয়।

আজানের ক্ষেত্রে দূর পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছানো একটি স্বীকৃত প্রয়োজন। কিন্তু ওয়াজ, বয়ান, কুরআন তেলাওয়াত বা জিকিরের আওয়াজ ঘরে ঘরে বা পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কোনো শরয়ী বাধ্যবাধকতা নেই।

উচ্চ আওয়াজে ইবাদত : শরিয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর

ইসলামের মৌলিক নীতি হলো কেউ যেন অপরের কষ্টের কারণ না হয়। ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল-বাহরুর রায়েকে বলা হয়েছে,

‘ইমাম যদি মুসল্লিদের প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম করে উচ্চস্বরে কিরাআত করেন, তবে তিনি ভুল করেন।’

অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত উচ্চশব্দ নিজেই একটি শরয়ী ত্রুটি।

বাস্তবে দেখা যায়, বড় লাউড স্পিকারের কারণে নারী, বৃদ্ধ, রোগী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, শিশু ও গর্ভবতী নারীরা চরম কষ্টে পড়েন। অনেক সময় তারা ঘরে শান্তিতে নামাজ, জিকির বা বিশ্রামও নিতে পারেন না। অথচ অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা গুনাহ এ বিষয়ে শরিয়তের অবস্থান স্পষ্ট।

সাহাবায়ে কেরামের যুগে শব্দ-সংযম

ইসলামি ইতিহাসে শব্দ-সংযম একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। উমর ইবনু শায়বা (রহ.) বর্ণনা করেন, মদিনায় এক ব্যক্তি হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরের কাছে উচ্চস্বরে ওয়াজ করতেন। এতে তার একাগ্রতা নষ্ট হতো। বিষয়টি জানার পর হজরত উমর (রা.) তাকে সেখানে ওয়াজ করতে নিষেধ করেন এবং পুনরাবৃত্তি করলে শাস্তি দেন। (আখবারুল মাদিনা)।

বিশিষ্ট তাবেয়ি আতা ইবনু আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, ‘একজন আলেমের উচিত তার কণ্ঠস্বর যেন তার মজলিসের সীমা অতিক্রম না করে।’

ফুকাহায়ে কেরাম আরও বলেন, কেউ যদি বাড়ির ছাদে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করে মানুষের ঘুম নষ্ট করে, তবে সে গুনাহগার হবে। (ফাতাওয়ায়ে শামি)।

রাতভর মাইক ব্যবহার

বর্তমানে গভীর রাত পর্যন্ত মাইক লাগিয়ে ওয়াজ চালানো একটি সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে আশপাশের মানুষের ঘুম, আরাম ও স্বাভাবিক জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। অথচ ইসলাম কাউকে কষ্ট দিয়ে দাওয়াত দেওয়ার অনুমতি দেয় না।

রাসূল (সা.) ইতিকাফরত অবস্থায় সাহাবিদের উচ্চস্বরে কিরাত পাঠে নিষেধ করে বলেন,

‘তোমরা একে অন্যকে কষ্ট দিও না।’ (সুনানে আবু দাউদ)।

এ হাদিস প্রমাণ করে-উচ্চ আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াতও যদি কষ্টের কারণ হয়, তবে তা নিষিদ্ধ। সুতরাং ওয়াজ মাহফিলে এ বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া আবশ্যক।

ওয়াজ মাহফিল ও দাওয়াত নিঃসন্দেহে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মহান মাধ্যম। তবে ইবাদতের সৌন্দর্য নিহিত থাকে তার প্রভাব ও ফলাফলে। যে আমল মানুষকে নুরের পথে না নিয়ে কষ্টের কারণ হয়, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির উপযুক্ত হতে পারে না।

অতএব, মাইক ও শব্দযন্ত্র ব্যবহারে সংযম ও ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। যেখানে ভেতরের ব্যবস্থায় কাজ চলে, সেখানে বাইরের লাউড স্পিকার পরিহার করা উচিত। বিশেষত আশপাশের বৃদ্ধ, অসুস্থ, নারী ও শিশুদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াই ইসলামি শিষ্টাচার।

দাওয়াতের প্রকৃত সৌন্দর্য কণ্ঠের উচ্চতায় নয়; বরং বক্তব্যের গভীরতা, আন্তরিকতা ও রহমতে।

আল্লাহতায়ালা আমাদের দাওয়াতকে হিকমতপূর্ণ করুন এবং আমাদের কণ্ঠকে রহমতের বাহক বানান। আমিন।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম