কুরআনের ভাষ্যে অভিবাসন
মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজকের বিশ্বে অভিবাসন আন্তর্জাতিক আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে জাতিসংঘ ১৮ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশও এ দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করে, কারণ প্রবাসীরা শুধু পরিবারের ভরসায়ই নন, তারা জাতীয় অর্থনীতিরও প্রধান চালিকাশক্তি।
ইসলাম অভিবাসনকে কীভাবে দেখে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে চোখে ভেসে ওঠে কুরআনের মহিমাময় অনেক আয়াত। তবে সূরা কাসাসের ২২ থেকে ২৮নং আয়াতে বর্ণিত হজরত মূসা (আ.)-এর মাদায়েন অভিমুখে গমনকে অভিবাসনের অনন্য উদাহরণ হিসাবে গণ্য করা যায়। মূসা (আ.) যখন আদিষ্ট হয়ে অজানা পথের যাত্রী হলেন, তখন তার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘আশা করি, আমার প্রতিপালক আমাকে সঠিক পথ দেখাবেন।’ অচেনা গন্তব্যের পথে এ যেন অভিবাসনের প্রথম শিক্ষা, অজানার ভেতরেও ইমান, প্রজ্ঞা আর প্রস্তুতির আলোকে এগিয়ে চলা। মাদায়েনের কূপের পাশে তিনি দেখলেন একদল পুরুষ পশুদের পানি পান করাচ্ছে, আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন তরুণী, সংকোচে ও অপেক্ষায়। তাদের জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল, তারা পুরুষদের সরে যাওয়ার অপেক্ষা করছে, কারণ তাদের পিতা ছিলেন বৃদ্ধ। মূসা (আ.) নিজেই তাদের পশুগুলোকে পানি পান করালেন এবং অবসন্ন দেহ নিয়ে ছায়ায় বসে বললেন-‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি যে অনুগ্রহই দাও না কেন, আমি তারই মুখাপেক্ষী।’ এ প্রার্থনায় প্রতিফলিত হলো শ্রমজীবী মানুষের সেই চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা, শ্রম দেওয়ার পর বিশ্রাম গ্রহণ এবং শ্রমের বিনিময়ে জীবিকার ন্যায্য প্রাপ্তি।
এরপর ওই নারীদের পিতা মূসা (আ.)কে আহ্বান করলেন এবং কাজের প্রস্তাব দিলেন। কন্যাদের একজন তার পিতাকে পরামর্শ দিলেন-‘হে পিতা! একে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করুন। উত্তম শ্রমিক তো সেই, যে শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত।’ এই বাণী যেন অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য অনন্ত শিক্ষা হয়ে রইল, কর্মে দক্ষতা আর অন্তরে আমানতদারিতা। দক্ষতা আর সততার সমন্বয়ই একজন শ্রমিককে করে তোলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এখানেই ইসলামের অভিবাসন দর্শন উন্মোচিত হয়। অচেনা পথে যাত্রার আগে প্রস্তুতি অপরিহার্য, ভাষা, সংস্কৃতি, আইন-কানুন ও পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা ছাড়া নিরাপদ যাত্রা অসম্ভব। শ্রম এখানে লজ্জার নয়, বরং সম্মানের; শ্রম দিয়েই মানুষ সম্মান অর্জন করে। নারী-পুরুষ উভয়েরই কর্মক্ষেত্রে অধিকার রয়েছে, তবে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। আর কর্মী হিসাবে শ্রেষ্ঠ সেই, যে শক্তিতে সক্ষম এবং যে সৎ, দায়িত্ববান ও প্রতিশ্রুতিশীল।
আজকের বাস্তবতায় কোটি কোটি মানুষ জীবিকার সন্ধানে প্রবাসী হচ্ছেন। তাদের স্বপ্ন, পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো, দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আনা। কিন্তু পথে বাধা কম নয়। প্রবাসীরা অনেক সময় শোষণের শিকার হন, প্রতারিত হন দালালের হাতে, বঞ্চিত হন ন্যায্য অধিকার থেকে। অথচ ইসলামের শিক্ষা স্পষ্ট, অভিবাসন বৈধ, তবে অন্যায়, শোষণ ও প্রতারণা এতে স্থান পায় না। নিয়োগদাতা দেশের দায়িত্ব শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিরাপদ কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা।
অভিবাসন শুধু জীবিকার সংগ্রাম নয়, এটি মানুষের জন্য এক পরীক্ষা, সে তার কর্মে কতটা সততা, বিশ্বস্ততা আর দায়িত্বশীলতা বজায় রাখছে। উত্তম শ্রমিকের ঘামই পরিণত হয় আশীর্বাদে, পরিবারে আনে সুখ, মাতৃভূমিতে আনে সমৃদ্ধি, আর গন্তব্য দেশেও হয়ে ওঠে কল্যাণের উৎস। অভিবাসন একদিকে বেদনার, আবার অন্যদিকে আশার আলো। কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী, প্রকৃত শ্রমিক সেই, যার কর্মে শক্তি আর হৃদয়ে বিশ্বস্ততা। এমন অভিবাসনই শেষ পর্যন্ত মানবতার জন্য হয়ে ওঠে কল্যাণের বার্তা।
