হিলফুল ফুজুল : মানবতার প্রথম শান্তিসংঘ
সৈয়দ এএফএম. মঞ্জুর-এ-খোদা
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজকের এ সংঘাতময় পৃথিবী যখন যুদ্ধবিগ্রহ, অন্যায়-অবিচার এবং জাতিগত আক্রোশ ও সহিংসতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে; তখন কিশোর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুজুল নামক কল্যাণসংঘের আলোচনা যেন নতুন করে অতি আবশ্যক হয়ে উঠছে। তাই আপনাদের জ্ঞাতার্থে আজ আমি হিলফুল ফুজুলের পটভূমি ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরব-
ফুজ্জার যুদ্ধের উৎপত্তি
তৎকালীন আরবে প্রচলিত নিয়মানুসারে রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম মাসে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। আরবরা যুদ্ধবিরতির এ মাসগুলোয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমোদ-প্রমোদে মগ্ন থাকত। আর যুদ্ধবিরতির এ হারাম সময়ই সংঘটিত হতো আরবের সর্ববৃহৎ উকাজ মেলা। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে উকাজ মেলার ব্যবসায়িক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে কিনানা ও হাওয়াজিন গোত্রের ২ ব্যক্তির মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব বাধে। এ দ্বন্দ্বের জের ধরে কিনানা এবং হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। নিষিদ্ধ মাসে এ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল বলে একে ‘হারবুল ফুজ্জার’ অর্থাৎ নিষিদ্ধ যুদ্ধ বলা হয়। এ যুদ্ধ পরপর ৪ বছরে মোট ৪ বার সংঘটিত হয়েছিল। ১ম যুদ্ধটি কিনানা ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে, ২য় যুদ্ধটি কুরাইশ (বনু কিনানার শাখা গোত্র) ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে, ৩য় যুদ্ধটি কিনানা ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে সংঘটিত হয়। ৪র্থ ও সর্বশেষ ফুজ্জার যুদ্ধের একপক্ষে ছিল কিনানা, কুরাইশ ও তাদের মিত্র গোত্রগুলো এবং অপরপক্ষে ছিল হাওয়াজিন, কায়স আয়লান ও তাদের মিত্রগোত্রগুলো। নিজেদের মিত্রগোত্র কিনানাকে সহযোগিতা করার জন্য কুরাইশ বংশের লোকরা এক ধরনের বাধ্য হয়েই এ ৪টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।
হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনে ফুজ্জার যুদ্ধ
হজরত মুহাম্মাদ (সা.) প্রথম ৩টি ফুজ্জার যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও ৪র্থ ফুজ্জার যুদ্ধে তিনি স্বীয় চাচাদের বারবার অনুরোধে অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৫ মতান্তরে ২০ বছর। কিশোর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে শামিল হননি। তিনি শুধু শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত তির কুড়িয়ে এনে চাচাদের হাতে তুলে দিতেন। এর পাশাপাশি তিনি যুদ্ধে আহতদের সেবাও করতেন। পরবর্তী সময়ে ৪র্থ ফুজ্জার যুদ্ধে এ অংশগ্রহণ সম্পর্কে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজেই বলেন, ‘আমি যদি এতটুকু অংশগ্রহণও না করতাম, তবে তাই উত্তম ছিল।’ (সিরাত বিশ্বকোষ, ই. ফা. বা., খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা ২৮২)।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ৪র্থ ফুজ্জার যুদ্ধ কয়েক দিন স্থায়ী ছিল। তবে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) শুধু ১ দিনই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন।
হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা
৪র্থ ফুজ্জার যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, সাধারণ মানুষের প্রাণহানি, নারীদের স্বামী হারানোর বেদনা, পিতাহারা এতিম শিশুদের করুণ আহাজারি কিশোর হজরত মুহাম্মাদ (সা.)কে অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত করে তোলে। তাই ফুজ্জার যুদ্ধের সমাপ্তির পর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মক্কাবাসীর অহেতুক রক্তপাত ও সংঘর্ষ বন্ধ করার জন্য গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হন। জাহেলিয়াতের যুগে স্বগোত্রের কোনো লোক অন্যায় করলেও আরবরা তার পক্ষই সমর্থন করত। কিশোর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বুঝতে পারলেন, আরবদের এরূপ অন্ধ গোত্রপ্রীতিই বেশির ভাগ যুদ্ধের মূল কারণ। তাই তিনি দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করলেন, এখন থেকে যে ব্যক্তিই অন্যায় করুক না কেন, তাকে প্রতিরোধ করতেই হবে। কোনোভাবেই সমাজের প্রতাপশালী লোকদের দুর্বল শ্রেণির ওপর অত্যাচার করতে দেওয়া যাবে না। মূলত, এরূপ চিন্তা থেকেই ৪র্থ ফুজ্জার যুদ্ধের আনুমানিক ৪ মাস পর কিশোর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মক্কাবাসীদের মাঝে শান্তি স্থাপনের জন্য তার চাচা জুবায়ের ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে একটি শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিলেন। কিশোর বয়সেই স্বীয় ভাতিজার এরূপ অসাধারণ মানবতাবোধ ও বিচক্ষণতার পরিচয় পেয়ে জুবায়ের ইবনে আবদুল মুত্তালিব অভিভূত হলেন এবং সাদরে এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।
হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অনুরোধে জুবায়ের ইবনে আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ তরুণদের সম্মুখে এ প্রস্তাব উত্থাপন করলে তারাও এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় কুরাইশ বংশের অন্যতম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আবদুল্লাহ্ ইবনে জুদআনের ঘরে জুবায়ের ইবনে আবদুল মুত্তালিব একটি জরুরি সভা আহ্বান করলেন। এ সভায় অন্যদের সঙ্গে হজরত মুহাম্মাদ (সা.)ও উপস্থিত হলেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে সভায় উপস্থিত হাশিম, জুহরাসহ কুরাইশ বংশের বিভিন্ন গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একটি শান্তিসংঘ গঠনের ব্যাপারে একমত হলেন। ইতিহাসে এ সংঘটিই ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে খ্যাত।
আরবি ভাষায় প্রতিজ্ঞাকে বলা হয় ‘হিলফ’ আর ‘ফুজুল’ অর্থ জালিমের কাছে হতে মজলুমের প্রাপ্য অধিকার আদায়। তাই ‘হিলফুল ফুজুল’ বলতে বুঝায়, জালিমের কাছ থেকে মজলুমের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের প্রতিজ্ঞা। এজন্যই এ শান্তিসংঘের নাম রাখা হয় হিলফুল ফুজুল। হিলফ শব্দটির আরেকটি অর্থ সংঘ, আর ফুজুল শব্দের আরেকটি অর্থ কল্যাণ। তাই হিলফুল ফুজুল দ্বারা কল্যাণসংঘও বুঝানো হয়। এ সংঘের সদস্যদের বলা হয় ‘আহলু হিলফিল ফুজুল’ অর্থাৎ কল্যাণসংঘের সদস্য।
কিশোর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন হিলফুল ফুজুলের আহ্বায়ক ও প্রধান উদ্যোক্তা। হিলফুল ফুজুলের সদস্যরা ৫টি বিশেষ দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। এগুলো হলো-
১. আমরা দেশের অশান্তি দূর করব;
২. আমরা বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা প্রদান করব;
৩. আমরা গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করব;
৪. আমরা শক্তিশালীদের দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করতে দেব না;
৫. আমরা বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করব।
পরবর্তী সময়ে হিলফুল ফুজুলের এ ঐতিহাসিক প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন-
‘আমি আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে আমার চাচাদের সঙ্গে এমন এক সন্ধিতে অংশগ্রহণ করেছিলাম, যদি এর পরিবর্তে আমাকে আরবের অসংখ্য লাল উটও (দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান) দেওয়া হতো, তা সত্ত্বেও আমি সেগুলো ত্যাগ করে এ সন্ধিকেই গ্রহণ করতাম। আর যদি ইসলামি যুগের এ সময়েও এরকম একটি সন্ধির প্রতি আমাকে আহ্বান করা হয়, তাহলে আমি অবশ্যই এতে অংশগ্রহণ করব।’ (মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস কর্তৃক অনূদিত ফিকহুস সিরাত, মুহম্মদ আল গাযালী আল মিশরী, পৃষ্ঠা ৮১; কালান্তর প্রকাশনী কর্তৃক অনূদিত সিরাতুন নবী (সা.), খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ১৩১)।
হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার পর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সমাজের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করা শুরু করলেন। তিনি সারা দিন মক্কার পথে পথে ঘুরে এতিম শিশু, অসহায় নারী, বৃদ্ধ এবং সমাজের সর্বস্তরের দুঃখী মানুষের দুঃখ দূর করার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। এভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মক্কার সব শ্রেণির মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠলেন নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত এবং সাহায্যকারী পরম বন্ধু। কিশোর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে মক্কায় যুদ্ধ, রক্তপাত, সন্ত্রাস, অত্যাচার-অনাচার ব্যাপকহারে কমে এলে এবং সমগ্র মক্কায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করল। এ কারণে সেসময় মক্কা নগরীর বাইরেও হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আরবের সর্ব সাধারণের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
হিলফুল ফুজুল বা কল্যাণসংঘ গঠনের মাধ্যমে তৎকালীন যুবসমাজ শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে যুবসমাজকে সংগঠিত করে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠায় এটিই ছিল প্রথম উদ্যোগ। মূলত, হিলফুল ফুজুল বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম শান্তিসংঘ। পরবর্তীকালে এ হিলফুল ফুজুলের অনুসরণে দেশে-বিদেশে অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। হিলফুল ফুজুলের প্রায় ৭০০ বছর পর ইংল্যান্ডে গঠিত ‘অর্ডার অব নাইটহুড’ (Order of Knighthood) নামক কল্যাণ সমিতির মূলনীতি ছিল হিলফুল ফুজুলের অনুরূপ। এমনকি ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘জাতিসংঘ’ (United Nations) হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুজুলের অনুসরণেই গঠিত হয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান বিশ্বের অস্থিরতা দূর করতে হিলফুল ফুজুলের মূলনীতিগুলো অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি আল্লাহর রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুজুলের সাম্য, শান্তি ও মানবিকতার আদর্শ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে পারি; তাহলে অচিরেই বিশ্বব্যাপী শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করবে ইনশাআল্লাহ। তথ্যসূত্র : স্মৃতি মোবারক : হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ও আহলে বাইতের জীবনী নামক গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
