Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

কারবালার স্মৃতিবাহী মহররম

Icon

কুলসুম রশীদ

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কারবালার স্মৃতিবাহী মহররম

আরবি বছরের শেষ মাস জিলহজ এবং শুরু মহররম দুটিই ত্যাগের মাস। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আরবি ১২টি মাস ছিল এবং বছরের শুরুর দিনও উদ্যাপন করা হতো। রাসূল (সা.)ও এ দিনটিকে ঈদের দিনের মতো খুশি মানাতেন। এ দিনে পুরোনো বছরের গুনাহ থেকে আমাদের মাফ চেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো দরকার।

কারণ এদিন নতুন বছরের হালখাতাকে উন্নত করা হয়। হ্যাঁ আমাদেরও একটি হালখাতা আছে। যা আমাদের কাঁধের ফেরেশতাদ্বয় লিপিবদ্ধ করে চলেছেন। যা কেয়ামতের দিন নিজেকেই পড়ে শোনাতে হবে মহান রব্বুল আলামিনের সামনে। আমাদের আমলনামা লিপিবদ্ধ করার জন্য কেরামন-কাতেবিন (কেরামন অর্থ সম্মানিত, কাতিব অর্থ লেখক, যেহেতু দুজন তাই কাতেবিন বলা হয়) প্রতি ১২ ঘণ্টা পর পর তাদের বদলি হয়। রাসূল (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পর থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হয়।

মহররম মাসকে রাসূল (সা.) ‘মুহাররামুল হারাম’ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, এ মাসে বিশেষ করে ঝগড়া, অন্যায়, অবিচার ইত্যাদি হারাম। ৬১ হিজরিতে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর আনন্দ উদ্যাপন স্তিমিত হয়ে যায়। কারবালার পবিত্র ভূমিতে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) শত্রুর আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং মুসলিম উম্মাহকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন নিজের জীবন দান করে।

ধর্ম এবং রাষ্ট্র আলাদা নয়। রাসূল (সা.) মদিনায় হিজরত করেছেন শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচার করার জন্য। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেখানেই তিনি ইসলামের পরিপূর্ণতা এনেছিলেন। পূর্ণাঙ্গ ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। তার ওফাতের পর সবার পরামর্শ অনুযায়ী যোগ্য প্রার্থী হিসাবে হজরত আবু বকর (রা.) এরপর একে একে হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.) এবং শেষ খোলাফায়ে রাশেদীন হজরত আলী (রা.)। হজরত আলী (রা.) শাহাদতের পর চুক্তিনামা মোতাবেক তার বড় সন্তান হজরত ইমাম হাসান (রা.) খেলাফতের মসনদে বসেন।

হজরত হাসান (রা.) মুয়াবিয়ার কূটনীতির কারণে মসনদে ৭ মাস বসতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন খুব সাদাসিধা ভদ্র ও নম্র। মদিনায় তখন দুটি পাওয়ার একসঙ্গে রাজত্ব করছিল। একদিকে হজরত ইমাম হাসান (রা.) চুক্তিনাম মোতাবেক, আর অন্যদিকে (চুক্তিনামা বাদ দিয়ে) আমির মুয়াবিয়া। কিন্তু হজরত হাসান (রা.) সম্মানের জন্য আক্রমণ করছিলেন না। ওদিকে মুয়াবিয়া সব মানুষকে নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর স্ত্রী জায়েদাকে ফুসলিয়ে লোভের বশবতী করে তাকে দিয়ে বিষ পানে শহীদ করে।

হজরত হাসান (রা.)-এর শহীদের পর ইমাম হোসাইন (রা.) খেলাফতের হকদার ছিলেন। কিন্তু ইয়াজিদ মসনদে বসে পড়ল। বিশ্বাসঘাতক, দুশ্চরিত্র, লম্পট ও মদ্যপ ইয়াজিদ খলিফা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর জীবন থেকে ইসলাম ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ফলে চতুর্দিকে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। ইয়াজিদ নিজের ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য হজরত ইমাম হোসাইন (রা.), ইবনে আবু বকর (রা.), ইবনে উমর (রা.) ও ইবনে যুবায়ের (রা.)কে বশ্যতা স্বীকার করাতে চাইল। কিন্তু কেউ রাজি হয়নি।

হজরত হোসাইন (রা.) সাবান মাসের তিন তারিখে মদিনা ছেড়ে মক্কায় আগমন করেন। বশ্যতা না স্বীকার করার প্রমাণস্বরূপ। কুফাবাসীর কাছ থেকে প্রচুর চিঠি আসছিল, তারা ইয়াজিদের জুলুমে অতিষ্ঠ এবং তিনি এলে তার হাতে তারা বায়াত হয়ে ইসলামের পথে চলতে পারবে। ইমাম সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাহায্য প্রার্থীদের সাহায্য করা জরুরি মনে করলেন। তবে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করলেন ভাই মুসলিমকে প্রথমে পাঠিয়ে। ইয়াজিদ বাহিনী কৌশলে মুসলিমকে দিয়ে মিথ্যা চিঠি লিখিয়ে তাকে শহীদ করে ফেলে। ইয়াজিদ ইবনে জিয়াদকে কুফার গভর্নর করে জনগণকে বিপথে অর্থাৎ ইয়াজিদের পক্ষে অবস্থান নিতে বলে পুরস্কারের বিনিময়ে।

এদিকে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) মুসলিমের সম্মতিসূচক চিঠি পেয়ে ৭২ জন পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথি নিয়ে ৭ জিলহজ কুফার উদ্দেশে রওয়ানা হন। ইয়াজিদ সেনারা কারবালার প্রান্তরে পথ রোধ করলে তিনি জানান, যুদ্ধ করতে আসেননি এবং মক্কায় ফিরে যেতে চাইলেন। কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদ তাতে রাজি না হয়ে ইয়াজিদের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করার জন্য বাধ্য করে তুলল।

ইমাম জানালেন, তা প্রাণের বিনিময়েও সম্ভব নয়। ৮ মহররম ফোরাতের তীরে পাহারা শুরু হলো। কেউ পানি আনতে গেলেই তাকে শাহাদতের পেয়ালা পান করতে হয়েছিল। বন্ধু, আত্মীয়, পরিবার পরিজনদের একের পর এক শহীদ হতে দেখেও দৃড় প্রতিজ্ঞ ইমাম হোসাইন (রা.) ক্ষণিকের জন্যও বিচলিত হননি, অটল দৃঢ়তার সঙ্গে একাকী শতসহস্র ইয়াজিদ সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে সিংহের মতো যুদ্ধ করে আনন্দচিত্তে শাহাদতের পেয়ালা পান করেছিলেন মহররমের ১০ তারিখে। ইয়াজিদের জন্য এটা ছিল রাজ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লড়াই। পক্ষান্তরে ইমাম হোসোইন (রা.) অনুসরণ করেছিলেন আল্লাহর হুকুম : তোমাদের সেই উম্মত হওয়া চাই, যারা সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজে বাধা দেয়। যে উম্মতের মধ্যে এ গুণ আছে তারাই তো সফলকাম (সূরা আল-ইমরান ১০৪)। আশুরার রাত অর্থাৎ ৯ মহররমের দিবাগত রাতে তিনি সারা রাত নামাজ, তওবা, দোয়া ও কান্নায় কাটিয়েছিলেন। রাতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই এ রাতে তওবা, ইস্তেগফার ও এবাদত-বন্দেগির মধ্যে কাটানো উত্তম।

পুরো মহররম অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। আল্লাহ পাক তার প্রিয়জনদের মাফ করে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করেছিলেন। রাসূল (সা.) এ মাসে কম কথা বলতেন। কুরআন তেলাওয়াত ও নফল নামাজে সময় অতিবাহিত করতেন। মহররম মাসে নাজিলকৃত আয়াত ‘তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে ইবাদতের সঙ্গে।’ ১-১০ অথবা ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখে রোজা রাখা। নিজে ভালো খাবার খাওয়া এবং মিসকিনদের ভালো খাবার খাওয়ানো, খতমে কুরআন, খতমে দরুদ শরিফ, ফাতেহা শরিফ ও তার সওয়াব রাসূল (সা.)-এর দরবারে হাদিয়া করে দিয়ে তার অসিলায় সব নবীঈন, সিদ্দিকীন খাস করে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি সওয়াবরেসানি করা, এভাবে যদি আমরা হিজরি নববর্ষকে মুহাররামুল মুবারক বলে বরণ করে নিই তবে আগামী বছর পর্যন্ত অভাবহীনভাবে শান্তির সঙ্গে কাটাতে পারব ইনশাআল্লাহ।

লেখক : কবি ও গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম