Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

দেনমোহর নারীর স্বনির্ভরতার সিঁড়ি

মুহাম্মদ এনায়েত কবীর

মুহাম্মদ এনায়েত কবীর

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেনমোহর নারীর স্বনির্ভরতার সিঁড়ি

মোহর আল্লাহ প্রদত্ত এক অর্থনৈতিক অধিকার। নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদার সনদ। নববধূর মূল্যায়ন ও সম্মানের প্রতীক। স্বামীর ওয়াজিব দায়িত্ব। মোহর আদায় কোনো দয়া বা অনুগ্রহ নয়। বরং আল্লাহর আদেশ। যেনতেন পরিমাণ মোহর ধার্য করা যাবে না। বরং স্বামীর সামর্থ্য ও সম্মানজনক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করতে হবে। মোহর স্ত্রীর একান্তই নিজস্ব সম্পদ। এতে কারও অংশীদারত্ব নেই। কারও হস্তক্ষেপেরও কোনো সুযোগ নেই।

পিতা-মাতা, ভাইবোন কেউই তাতে ভাগ বসাতে পারবে না। মোহর আদায় সম্পর্কে কুরআনে পরিষ্কার নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা নারীদের মোহর স্বতঃস্ফূর্তভাবে আদায় করও। যদি খুশি মনে তারা মোহরের কিছু অংশ তোমাদের দিয়ে দেয়, তাহলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারবে (সূরা নিসা, আয়াত : ৪)।

মোহর আদায়ে কোনো রকম নয়-ছয় করা অপরাধ। মোহর আদায়ে পিছুটান বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া মানে নিজেকে ঠকানো। এমন ব্যক্তিরা শেষ বিচারে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হবে। আল্লাহর সামনে ব্যভিচারী হিসাবে উপস্থিত হবে। নবীজি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করে মোহর বাকি রাখল। এরপর সে আংশিক বা একেবারেই মোহর আদায় না করার ইচ্ছা করল, এমন ব্যক্তি ব্যভিচারী বলে গণ্য হবে। আল্লাহর সঙ্গে সে ব্যভিচারী হিসাবে সাক্ষাৎ করবে (কানজুল উম্মাল, ৮ম খণ্ড ২৪৮ পৃষ্ঠা)।

মোহর আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু সমাজে এ ওয়াজিবকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ধর্ম-কর্ম পালনকারী ব্যক্তিরাও এ বিষয়ে উদাসীন। মোহর সম্পর্কে সমাজের মানসিকতা হলো, ছেলেমেয়ে ঠিক থাকলেই সব ঠিক। মোহর যাই ধরা হোক, সমস্যা নেই। ভাবসাবে মনে হয়, তা আদায় করা তেমন জরুরি নয়। ফলে কেউ উচ্চ পরিমাণে আবার কেউ স্বল্প পরিমাণে মোহর ধার্য করে। কেউ মনে করেন, বিয়েশাদিতে অনেক কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। মোহরও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার একটি স্বাভাবিক অংশ।

অথচ মোহর নিছক কোনো কথার কথা বা ঐচ্ছিক বিষয় নয়। বরং তা একটি ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক। চমক সৃষ্টি কিংবা বড়লোকি দেখানোর জন্য অস্বাভাবিক পরিমাণ মোহর ধার্য করা অনুচিত। মোহর আদায়ে অক্ষমতা বা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেশি পরিমাণ মোহর ধার্য এক ধরনের প্রতারণা। এরপর মোহর না দিয়ে স্ত্রীর কাছে মাফ চাওয়াও এক ধরনের আত্মমর্যাদাহীন কাজ ও ধোঁকাবাজি। এমন ঠগ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। এমন ঠগ চরিত্রের লোকেরা কেয়ামতের দিন বান্দার হক অনাদায়ের কারণে ধরা খেয়ে যেতে পারে।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস। নবীজি ইরশাদ করেন-কেয়ামতের দিন প্রত্যেক হকদারকে অবশ্যই হক বুঝিয়ে দিতে হবে। এমনকি শিংবিহীন ছাগলের জন্য শিংযুক্ত ছাগল থেকে বদলা গ্রহণ করা হবে (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৫৮৫)। মোহর নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সিঁড়ি। স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার। মোহর স্বামীর ওপর এক ধরনের ঋণ; তা আদায় না করে স্বামী মারা গেলে ত্যাজ্য সম্পত্তি থেকে মোহর পরিশোধ করা হবে। এক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীদের মাঝে মিরাস বণ্টনের আগে স্ত্রীর মোহরের টাকা আদায় করতে হবে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি মোহর ধার্য করে বিয়ে করে, কিন্তু মৃত্যুর আগে তা পরিশোধ না করে, তাহলে মিরাস বণ্টনের আগে স্বামীর ত্যাজ্য সম্পত্তি থেকে দেনমোহর আদায় করা হবে (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস নং-১৭১৭১)।

আল্লাহতায়ালা বলেন, মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তি বণ্টন করা হবে ওসিয়ত ও ঋণ পরিশোধ করার পর। এর আগে নয় (সূরা নিসা : ১১)।

ইবনে কুদামাহ (রহ.) লিখেন, যদি স্বামী স্ত্রীকে মোহর না দিয়ে মারা যায়, তবে তা তার সম্পদের মধ্য থেকে পরিশোধ করা হবে (আল মুগনি, খণ্ড-৭)। সাধ্যের বাইরে অস্বাভাবিক পরিমাণ বা অল্প পরিমাণ মোহর শরিয়ত অনুমোদন করে না। মোহরের পরিমাণ হওয়া চাই ভারসাম্যপূর্ণ, সহনীয় এবং মর্যাদাপূর্ণ। মোহরের ক্ষেত্রে ছেলের আর্থিক সামর্থ্য ও ইচ্ছাই বিবেচ্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, যার সম্পদের প্রাচুর্য আছে, সে তার প্রাচুর্য থেকে ব্যয় করবে আর যার রিজিক সীমিত, আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন, তা থেকেই ব্যয় করবে। আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে বাধ্য করেন না (সূরা তালাক : আয়াত-৭)।

হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, নারীদের মোহরের ব্যাপারে তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না। কেননা তা যদি দুনিয়ায় সম্মানের বিষয় বা আল্লাহর কাছে তাকওয়ার নিদর্শন হতো, তবে নবীজিই এ ব্যাপারে অধিক যোগ্য বলে গণ্য হতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : হাদিস-১৮৮৭)।

নবীজি ও সাহাবায়ে কেরামের রীতি এক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ। মোহরের ক্ষেত্রে সমাজে মোহরে ফাতেমি বেশি প্রচলিত। হজরত ফাতেমা (রা.)-এর বিয়েতে যে পরিমাণ মোহর ধার্য করা হয়েছিল, তাই হলো মোহরে ফাতেমি। মোহরে ফাতেমির পরিমাণ ছিল ৫০০ দিরহাম; যা বর্তমানে ১৫৩০.৯ গ্রাম রুপার সমতুল্য (জাওয়াহিরুল ফাতওয়া, ৪/৩৫০)। মোহর আদায় না করলে হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হক নষ্ট হয়। এজন্য কঠিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। নিজের সারা জীবনের আমল ও ইবাদতের সওয়াব পাওনাদারের আমলনামায় চলে যেতে পারে।

নবীজি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কারও হক নষ্ট করল, কেয়ামতের দিন তার সওয়াব পাওনাদার ব্যক্তিকে দিয়ে দেওয়া হবে। যদি হক নষ্টকারীর আমলনামায় সওয়াব না থাকে, তাহলে পাওনাদারের পাপগুলো ওই ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে (সহিহ মুসলিম : ২৫৮১)। মোহর আদায় না করলে পরকালীন জীবনে নেমে আসতে পারে লাঞ্ছনা ও ভয়াবহ শাস্তি। পরকালীন ব্যর্থতা থেকে বাঁচতে এখুনি সতর্ক হওয়া উচিত। জীবদ্দশায় স্ত্রীর মোহরানাসহ সব পাওনাদারের হক আদায় করে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ নিজের ঋণ নিজে পরিশোধ করাই স্বাভাবিক নিয়ম। আপনি নিজেই যদি তা না করেন, তাহলে আপনার মৃত্যুর পর অন্যরা ঋণ আদায় করে দেবে এমন আশা করা কতটুকু যৌক্তিক? তাই সময় থাকতেই সাধু সাবধান।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম