কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা স্মার্ট যুগের নিরিখে
শাইখ সিরাজ
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ ঘটছে মানুষের চিন্তা-চেতনার। এর ফলশ্রুতিতে পাল্টে যাচ্ছে সবকিছু। পৃথিবীতে গত কয়েক দশকে জীবনযাত্রা ও মানুষের চিন্তার যে বৈপ্লবিক বিকাশ ঘটেছে তা তার পূর্ববর্তী কয়েক শতকের পরিবর্তনের চেয়েও অনেক বেশি ও দৃষ্টান্তমূলক। অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মতো কৃষি ক্ষেত্রের পরিবর্তনটি আমার দৃষ্টিতে অনেক বেশি স্পষ্ট। কারণ, আমি কৃষি নিয়ে কাজ করি। কৃষকের সঙ্গে মিশি। তাদের সমস্যাগুলোকে নিজের সমস্যা মনে করে গণমাধ্যমে তুলি। সাফল্যগুলোকে দেশের সব সাফল্য হিসেবে তুলে ধরি। আমার চার দশকের এ পথচলার বিবেচনায় এ কথা অকপটে বললে ভুল হবে না যে, বর্তমান সময়টি কৃষির সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি সময়। সমৃদ্ধ একটি সময়। ফলে ফসলে অভাবনীয় প্রাচুর্য দেখছি আমরা। ধানসহ সব খাদ্যশস্য, সবজি, ফল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে আমাদের সাফল্য দৃষ্টান্তমূলক। বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে কৃষক আজকের উৎপাদন সাফল্য অর্জন করেছে। এর পেছনে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের যেমন প্রভাব রয়েছে। একইভাবে রয়েছে কৃষকের ব্যক্তি উদ্যোগ। উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ করে কৃষক নিজস্ব প্রচেষ্টায় কিছুটা বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে ফসল বৈচিত্র্য সৃষ্টির পেছনে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার যন্ত্রের এসব কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট গতি থাকলেও বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে এসে তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। গত দেড় দশক এসব কর্মকাণ্ডে অনেকটা গতি এসেছে। কৃষকের ব্যক্তি উদ্যোগগুলোই বাণিজ্যিক কৃষির ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক সাফল্য হিসেবে ধরা দিচ্ছে।
গত বছর নভেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৯ বছরে দেশে প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে পাঁচগুণ। ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ওই রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। বেড়েছে স্থূলকায় ও খর্বাকৃতির মানুষের সংখ্যাও। দেশে খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি একটি নিশ্চয়তার জায়গায় পৌঁছে গেছে। এখন কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যের প্রশ্নে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে সামনে রয়েছে।
গত দশ বছরে কৃষির বড় ধরনের যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তার অন্যতম জায়গাটি হচ্ছে কৃষিকাজ থেকে কৃষক সরে আসছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যখন কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে পারিবারিক কৃষির কথা ভাবছেন আমাদের দেশে তখন কৃষির পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে যাচ্ছে। অর্থাৎ বহুকাল ধরে কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকায় অভ্যস্ত পরিবারগুলো এখন কৃষি থেকে সরে গিয়ে নতুন প্রজন্মকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরিতে যুক্ত করছেন। এর পেছনে বড় এক কারণ, কৃষির উপকরণ ব্যয়ের পাশাপাশি শ্রমিক খরচ। বহুমুখী উপকরণ ও শ্রমিক খরচ ব্যয় করে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কৃষিকাজ করে খুব বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকছে না। তাদের কৃষিজমি বিক্রি অথবা ইজারা দিচ্ছেন কৃষি শ্রমিকের কাছে। কৃষিতে শ্রম দেয়া দিনমজুরদের একটি অংশ কৃষিজমির অধিকার লাভ করে পারিবারিকভাবে কৃষিতে মনোনিবেশ করেছেন। এ শ্রেণিটি নিজে কৃষিকাজ করার কারণে অনেকটা লাভবান হচ্ছেন।
অবশ্য, বলতেই হবে কৃষি পরিস্থিতির এ পরিবর্তনের ভেতর আরেকটি শ্রেণির নতুন উদ্ভব ঘটেছে। সেটি হচ্ছে কৃষি উদ্যোক্তা। এখন যুগ হচ্ছে কৃষি উদ্যোগের। মানুষের জমির মালিকানা যখন সংক্ষিপ্ত ও খণ্ড খণ্ড হয়ে এসেছে, তখন নতুন উদ্ভব হওয়া কৃষি উদ্যোক্তা শ্রেণি ওই খণ্ডিত ভূমি মালিকদের জমি কিনে নিয়ে অথবা দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়ে গড়ে তুলছেন আধুনিক কৃষি খামার। যেখানে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। যুগের চাহিদা পূরণের জন্য এখন অল্প জমিতে বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করার আধুনিক সব পদ্ধতির অনুসরণ চলছে। একদিকে ঊর্ধ্বমুখী উৎপাদন প্রক্রিয়া (Vertical Expansion) চলছে অন্যদিকে শুরু হয়েছে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে (Green house) চাষাবাদ। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু হয়েছে মাটিবিহীন কৃষিচর্চা (Soilless Farming). অনেকেই অ্যাকুয়াফনিক্স, ইড্রোপনিকের মতো কৃষি অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কৃষিতে অপরিহার্যভাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে সেরা অনুশীলনগুলো। যাকে বলা হচ্ছে ‘Good Agriculture Practices’। আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে সবজি ও ফল উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য ঘটেছে। কোনো কোনো সবজি ও ফল ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের অনুকরণে গ্রিন হাউসে করা হচ্ছে। আর বেশি ফলন পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন কোম্পানির আমদানি করা পরীক্ষিত বীজ।
আগেই বলেছি, কৃষির বহুমুখী উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ব্যক্তি উদ্যোগের অনেক বড় অবদান সূচিত হয়েছে। দেশি-বিদেশি গবেষণা সমন্বয়, উন্নত বীজ ও চারার ব্যবহার, কৃষক প্রশিক্ষণ ও উন্নত বাজার কাঠামোর কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে কৃষকের সচেতনা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি ও উন্নয়ন সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বলতেই হবে, তাদেরও ভূমিকার পেছনে এক উদ্বুদ্ধকরণের কাজটি করে চলেছে গণমাধ্যম। একজন উন্নয়ন সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের কৃষির পিছিয়ে থাকা চিত্র ও আজকের চিত্রটি আমার সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আমি দেখেছি, আমাদের কৃষক ঠিক কোন জায়গাতে পিছিয়ে। তাদের সংকটটি কোথায়? একটি ভালো অনুশীলন, একটি উন্নত পদ্ধতি বা প্রযুক্তি কিংবা একজন উদ্যোক্তার চিত্র যখন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, তখন তাতে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। একটি ভালো উদ্যোগ একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। একটি ভালো প্রযুক্তি এক কৃষক থেকে অন্য কৃষকে ছড়িয়ে পড়ে। আমি আশির দশকে এককভাবেই চেষ্টা করেছি কৃষককে একটি বৃত্ত থেকে বের করে আনতে। গণমাধ্যমের উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণা দিয়ে একজন কৃষক, গৃহিণী বা পেশাজীবীর উদ্যোগী মানসিকতাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছি। প্রথমদিকে ধীরগতিতে এর সাফল্য আসতে শুরু করলেও পরে দ্রুতগতিতে বহুমুখী সাফল্য আসতে শুরু করে। বলা বাহুল্য, ধান ও পাট চাষের বাইরে গিয়ে বহুমুখী ফসল উৎপাদন, বসতবাড়িতে সবজি ফলানো থেকে শুরু করে মজা পুকুরে মাছ চাষ, দুগ্ধ খামার গড়ে তোলা, বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন, ঘরোয়া মুরগি পালন থেকে বেরিয়ে বাণিজ্যিক পোল্ট্রি গড়ে তোলা থেকে শুরু করে বহুমুখী পরিবর্তনশীল ও উন্নত কৃষির স্বপ্ন রচনার ক্ষেত্রে প্রথমদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান এবং পরে চ্যানেল আইয়ের হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান অসাধারণ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছে ও হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে কৃষিখাতে উন্নয়নের পেছনে যতগুলো নিয়ামককে দাঁড় করানো যায়, এর মধ্যে অনন্য এক জায়গায় রয়েছে গণমাধ্যম।
বলতেই হবে সময়ের প্রয়োজনেই কৃষক অনেক বেশি উদ্যোগী হয়েছেন। সে কারও জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকেননি। নিজের বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে গেছেন। গণমাধ্যমে সেরা অনুশীলনগুলো দেখে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছুটে গেছেন। একসময় বহুমুখী প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ফসল বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু যখন এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বা দেশীয় কোনো সহযোগিতা হাতের নাগালে পায়নি, তখন সে বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ, অথবা কোনো উদ্যোক্তার বিদেশ থেকে আনা জাতের বীজ ও চারার দিকে ঝুঁকেছে। তারা চাষাবাদ করে বিস্ময়কর সাফল্য এনেছেন। তাদের বাণিজ্যি সাফল্য ও আগ্রহ দেখে বীজ কোম্পানিগুলো উদ্যোগী হয়েছে। তারা কৃষকের চাহিদা বুঝে বাণিজ্যিক পরিকল্পনা করেছে। একইভাবে কীটনাশক, সার কিংবা সমন্বিত বালাই দমন উপাদানেরও স্থানীয় বাজার গড়ে উঠেছে। সবমিলিয়ে কৃষির সামনে-পেছনে ঘিরে এখন বড় একটি বাণিজ্যিক বলয় গড়ে উঠেছে। যে কারণে, এককভাবে দেশের প্রবৃদ্ধিতে কৃষির অবদান দৃশ্যত কম অর্থাৎ ১৪ শতাংশে নেমে এলেও অর্থনীতিতে সামগ্রিক কৃষির অবদান অনেক বেশি।
কৃষি এখন বেশি বিনিয়োগনির্ভর বাণিজ্যিক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। বেশি মুনাফা ও উৎপাদনশীলতার জায়গাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন তথ্যপ্রযুক্তি। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষির প্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর। গত এক দশকের চিত্র যদি তুলে ধরা হয়, আমরা পৃথিবীর উন্নত দেশ থেকে যেসব কৃষি অনুশীলন তুলে এনেছি, বাংলাদেশের উদ্যোক্তা কৃষক সেই অনুশীলনেই মনোযোগী হয়েছেন। বলা বাহুল্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবগুলো আমাদের দেশের কৃষিতে পুরোপুরি পড়তে শুরু করেছে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ। প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।
তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বর্তমান সময়ে শুরু হওয়া ডিজিটাল বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। এটিকে এখন বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বিশেষজ্ঞরা যেভাবে বলছেন, এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনও হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা সবকিছু। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে।
এখন পৃথিবীতে নতুন নতুন যেসব কৃষিযন্ত্র আসছে তাতে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংস। আমরা প্রতি বছর চীনে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কৃষিযন্ত্র প্রদর্শনীতে যাই। সেখানে পৃথিবীর সর্বাধুনিক কৃষিযন্ত্রগুলো প্রত্যক্ষ করছি। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ কৃষিযন্ত্রে এখন রোবটিকস প্রযুক্তিরও সন্নিবেশ ঘটানো হচ্ছে। চিন্তা করা হচ্ছে, উৎপাদন খাতে মানুষের শ্রমকে কতটা কমিয়ে আনা যায়। একইসঙ্গে উৎপাদন দক্ষতা, পরিবর্তন দক্ষতা ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাকে সহজীকরণ করতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে জমি চাষে। জমি চাষে ৯৫ শতাংশ কলের লাঙ্গল ব্যবহার হচ্ছে। একইভাবে ধান মাড়াইয়ে ৯৫ শতাংশ মাড়াই যন্ত্র বা থ্রেসার ও সেচ ব্যবস্থায় ৯৫ শতাংশ পাওয়ার পাম্প ব্যবহার হচ্ছে। কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে ধীরগতিতে। ফসল তোলা বা হার্ভেস্ট-এ ১.৫ শতাংশ, রোপণে দশমিক ৫ শতাংশেরও কম। তবে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের হার দিনে দিনে বাড়ছে। এতে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। একইভাবে আমাদের দেশের কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদিত যন্ত্রের সঙ্গে আইওটি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সার্ক দেশগুলোর কৃষির যান্ত্রিকীকরণের নিবিড়তাবিষয়ক সাম্প্রতিক এক গবেষণার হিসেবে, বাংলাদেশে আমদানির বাইরেও ২০ শতাংশ কৃষিযন্ত্রের চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশে রয়েছে ৭০টি ফাউলি, ২ হাজার কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক কারখানা ও ২০ হাজারের মতো যন্ত্রপাতি মেরামত কারখানা। কৃষিযন্ত্রের যে কোনো পার্টসের ৬০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমান সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে বেশ জোর দিয়েছে। সব কৃষকের কৃষিযন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংম ভর্তুকি চালু রয়েছে। এছাড়া হাওরের কৃষকের জন্য বেশকিছু কৃষিযন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ছাড় রয়েছে ৭০ শতাংশ। এছাড়া কৃষিখাতে দেয়া ভর্তুকির ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকা বা ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কৃষিযন্ত্র কেনার জন্যও সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার অর্থ সহায়তায় কৃষি উৎপাদনে শুদ্ধতা অনুসরণের নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক উন্নয়ন সংগঠন সলিডারিডাড কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে দেশের কয়েকটি জেলায় বিষমুক্ত সবজি ফসল উৎপাদন ও মধ্যস্বত্বভোগীমুক্ত বাজার কাঠামো গড়ে তুলেছে। দক্ষিণাঞ্চলে তারা বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন বাজার ভিলেজ সুপার মার্কেট গড়ে তুলেছে। কৃষক নিজ গ্রামেই নির্দিষ্ট একটি বিক্রয় কেন্দ্রে তার উৎপাদিত সবজি বিক্রি করছে। সেখান থেকে উন্নত ব্যবস্থাপনায় সেগুলো ভিলেজ সুপার মার্কেটে চলে আসছে। সেখানে কৃষিপণ্যের পরিষ্কার করা, বাছাই ও উন্নত প্যাকেজিং করে রাজধানীর বাজারে সরবরাহ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়ায় সবজি বাজারজাতও করা হয়েছে। এ উদ্যোগগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নিরাপদ ফসল উৎপাদন ও পণ্যের সরবরাহ চেইন নিশ্চিত করা। এ একই প্রক্রিয়ায় মাছ, মাংস ও দুধ উৎপাদনে শুদ্ধতা অবলম্বন এবং সুনিশ্চিত বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কৃষক নিরাপদ ফসল উৎপাদনের অনুশীলনের আওতায় আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে খামারিদের মধ্যে নতুন আগ্রহ দেখা দিচ্ছে। উন্নত দেশগুলো কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তির সংযোজন করছে। বাংলাদেশেও এ স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। দেশে দুগ্ধ খামার ও প্রাণিসম্পদের খামারে এখন আইওটির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে গ্রামীণফোনের সহায়তায় ডিজিকাউ ও সূর্যমুখী প্রাণিসেবা নামের একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেছে প্রাণিসম্পদে আইওটি সেবা প্রদানের কাজ। গত এক বছর সাফল্যের সঙ্গে ডিজিটাল ও স্মার্টপ্রযুক্তি ব্যবহারে বেশ সাফল্য পাওয়া গেছে। উদ্যোক্তারা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক বেশি উৎসাহিত ও আশাবাদী। দেড় বছর আগে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাতঘরিয়ায় স্থাপিত ডাচ্ ডেইরি লিমিটেড সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত একটি স্মার্ট দুগ্ধ খামার। যেখানে ডিজিটাল ও স্মার্ট প্রযুক্তিগুলো সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধারণা করা যায়, কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের দেশ দুগ্ধ ও মাংসের খাত প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রি খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার শুরু হবে। এতে দুধ কিংবা মাংসের পুরোপুরি শুদ্ধতা যেমন নিশ্চিত করা যাবে, পাশাপাশি উৎপাদনও বাড়বে।
আমাদের মৎস্য খাতের জন্য আশাব্যঞ্জক এক উদ্ভাবনী সাফল্য রয়েছে। সেটি হচ্ছে মাছ চাষের পুকুরে অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মাছের পরিমিত খাদ্য দেয়ার প্রযুক্তি। বাংলাদেশের দুজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী শফিউল আলম ও তানিয়া তাদের দীর্ঘদিনের গবেষণার ফলাফল হিসেবে উদ্ভাবন করেছেন ‘স্মার্ট অ্যারেটর ও ফিডিং ডিভাইস’। যন্ত্রটি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতায় সেরা পুরস্কার লাভ করেছে। আশা করা যায়, এ যন্ত্রটি আমাদের দেশের মৎস্য খাতে যখন পুরোপুরি যুক্ত হবে, তখন রাসায়নিক ও ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত মাছ উৎপাদনে এক বিস্ময়কর সাফল্যের সূচনা ঘটবে।
আমাদের পুষ্টি নিরাপত্তার প্রশ্নে বহুমুখী সাফল্য সূচিত হচ্ছে। আমাদের দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও খামারিদের কল্যাণেই আমাদের মৎস্য খাতে বিস্ময়কর সাফল্য সূচিত হয়েছে। ফসল আবাদে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ বা মাটিবিহীন ঘরোয়া আবাদ পদ্ধতির মতোই মাছ চাষেও যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ‘রিসার্কুলেটেড অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম রাস’ ও ‘বায়োফ্লক’। এ দুটি পদ্ধতি ছাড়াও পানিতে অ্যামোনিয়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং চাষের ব্যয় কমিয়ে স্বল্প পরিসরে অনেক বেশি পরিমাণে মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জেগেছে। বাংলাদেশের বহুসংখ্যক শিক্ষিত সচেতন উদ্যোক্তা আধুনিক এ চাষ কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে মাছ চাষে বিশ্বব্যাপী আমাদের তৃতীয় অবস্থানকে দ্রুতই আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়াসী হয়েছেন। তাদের আশা অল্পদিনেই বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে পৃথিবীতে শীর্ষস্থানে পৌঁছতে পারবে। পাশাপাশি এ খাতে বড় ধরনের রফতানি সাফল্যও সূচিত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমুখী অভিঘাতে কৃষি বিপর্যস্ত হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করছে। বিশ্বব্যাপীই কৃষিবিষয়ক গবেষণায় এ বিষয়টি মাথায় রাখা হচ্ছে। উদ্ভাবন করা হচ্ছে বৈরী জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত ও কৃষি কৌশল। আসছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। এ বিষয়ে আমাদের মতো দেশেও গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন। সে সঙ্গে সর্বস্তরে কৃষির সেরা অনুশীলনগুলোতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ ও অভ্যস্ত করে তোলা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির আধুনিকতর উদ্ভাবন আইওটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারও জরুরি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষির বাণিজ্যিকায়নে বহুমুখী সাফল্য থাকলেও কৃষিক্ষেত্রে বড় এক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেটি হচ্ছে উৎপাদক শ্রেণির অনুকূল বাজার কাঠামো। এটি আজও পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। যে কারণে কৃষিক্ষেত্রে ফসল বৈচিত্র্য ও উৎপাদনের হার বাড়লেও কৃষক তার পণ্যের সঠিক মূল্য এখনও পাচ্ছে না। কৃষকের কাছে পণ্যমূল্য নির্ধারণের কোনো অধিকার যেমন নেই, একইভাবে নেই সরকার যন্ত্রের পক্ষ থেকে উৎপাদকের জন্য একটি মূল্য কমিশন গঠন করা। এটি কৃষকের বহুযুগের এক সংকট। যেটি সমাধানে আজও পর্যন্ত কার্যকর ও টেকসই কোনো উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয়নি। প্রচলিত বাজারব্যবস্থার চাপে কৃষক প্রতি ফসলের মৌসুমের শুরুতে কিছুটা মূল্য পেলেও পরে লোকসান গুনে থাকে। বছরে চারটি ফসল করতে পারার সুবাদে কোনো কোনো এলাকার কৃষক পুষিয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ এলাকার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ফসল উৎপাদন করে খুব বেশি লাভবান হতে পারেন না। চলমান স্মার্ট প্রযুক্তির যুগে কৃষকের জন্য অনুকূল বাজার কাঠামোর কার্যকর সমাধান দেয়ার মতো কোনো প্লাটফরম আজও পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এ বছর দেশে প্রথমবারের মতো সরকারি ব্যবস্থাপনায় মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে কৃষক নির্বাচন করে আমন মৌসুমের ধান সংগ্রহের অভিযানের কথা জানা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ উদ্যোগও সফলতা লাভ করেনি। কৃষকের বিবেচনায় এ কার্যক্রমেও অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। একইভাবে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রমের সময় নির্ধারণের জায়গাটিতেও কৃষকের মতপার্থক্য রয়েছে। তারা বলছেন, বাজারে নতুন ধান উঠতে উঠতে কম মূল্যে কৃষক বিক্রি করে দেয়ার পর সরকারি সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। এ কারণে সরকারি সংগ্রহ অভিযানে ধান বিক্রির সুযোগ কৃষক এবারও পাননি। ঠিক এ প্রশ্নেই কৃষকের সংকটটি রয়েছে দেশীয় ফল-ফসলের পূর্ণ মৌসুমে বাইরে থেকে আমদানির অনুমোদন দেয়ার সরকারিপ্রবণতা। বছরের পর বছর দেশীয় পেঁয়াজ, আদা, রসুন থেকে শুরু করে উচ্চমূল্যের ফল পেয়ারা, কুল ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এই অসম বাজার প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় কৃষককে। বিষয়গুলো সরকারের গোচরীভূত। যতদূর জানা যায়, এ বিষয়ে বারবার কৃষকের পক্ষ থেকে এবং গণমাধ্যমের উদ্যোগে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় কার্যকর একটি ব্যবস্থা নিতে নীতিগতভাবে উদ্যোগী হয়েছে। বাজারের চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করা গেলে কৃষি ক্ষেত্রে আজকের যে সাফল্য তা আরও দৃষ্টান্তমূলক জায়গায় পৌঁছে যাবে। একইসঙ্গে নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার আরও বেশি উদ্যোগী হলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে যেতে সমর্থ হব আমরা।
লেখক : কৃষি বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
