দেশি এসিতে স্বপ্নপূরণ
গুণগত বৈশিষ্ট্য ও মানের ক্ষেত্রে দেশে তৈরি করা এসি বিদেশি ব্র্যান্ডের এসির চেয়ে ভালো
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এক সময় এয়ারকন্ডিশন বা এসি ছিল বিলাসী পণ্য, যা শুধু ধনিক শ্রেণির মানুষের বাসায় শোভা পেত। গ্রীষ্মের খরতাপ অসহনীয় হয়ে ওঠায় সেই এসি এখন নিত্যব্যবহার্য গৃহস্থালিসামগ্রী। দেশীয় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোর কল্যাণে বর্তমানে স্থান পেয়েছে গ্রামাঞ্চলের নিম্নমধ্যবিত্তের ঘরেও। মাসিক কিস্তিতে, ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংক ঋণেও এসি বিক্রি হচ্ছে, সঙ্গে থাকছে ৫-১০ বছর মেয়াদি মেইনটেন্যান্স সুবিধা। ফলে সব শ্রেণির মানুষ স্বপ্নপূরণে দেশি ব্র্যান্ডের এসি কিনছেন।
দুই যুগ আগেও এসির বাজার ছিল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। শুরুতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে বিদেশি ব্র্যান্ডের এসি আমদানি করা হতো। অবস্থা বদলাতে থাকে ২০০০ সালের দিকে। আমদানিকারকদের অনেকেই চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ এনে দেশে সংযোজন শিল্প স্থাপন করেন। সরকার এ সময় নীতি সহায়তা দেওয়ায় দেশে ইলেকট্রনিক্স শিল্প বিকাশ লাভ করে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব ব্র্যান্ডের এসি উৎপাদন শুরু করে। এখন দেশে এসি-ফ্রিজ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে যমুনা ইলেকট্রনিক্স, ওয়ালটন, ইলেক্ট্রো মার্ট, ভিশন ইলেকট্রনিক্স, এলিট হাইটেক ইন্ড্রাস্ট্রিজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। চাহিদা থাকায় ঢাকার আনাচে-কানাচে নন-ব্র্যান্ডের এসি সংযোজন কারখানাও গড়ে উঠেছে। এসব কারখানার এসি গুলিস্তানের বিভিন্ন মার্কেটসহ গ্রামাঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে।
প্রতিবছর কী পরিমাণ এসি বিক্রি হয় তার নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছে নেই। তবে বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর ৩-৫ লাখ ইউনিট বিক্রি হয়। এই বাজার বাড়ছে ২৫ শতাংশ হারে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যমুনা, ওয়ালটন, কনকা (গ্রী), মিডিয়া, এলিট ও ভিশন ব্র্যান্ডের এসি চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করছে। বাজারের আকার বাড়তে থাকায় বিদেশি ব্র্যান্ডও বাংলাদেশে সংযোজন কারখানা স্থাপন করছে। তবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে দেশি এসি কেনার আগ্রহ বেশি। কারণ গুণগত বৈশিষ্ট্য ও মানের ক্ষেত্রে দেশে তৈরি করা এসি বিদেশি ব্র্যান্ডের এসির চেয়ে ভালো। দামে সাশ্রয়ী ও মানে আন্তর্জাতিক, দীর্ঘমেয়াদি ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি, সহজে খুচরা যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতা ও বিক্রয়োত্তর ফ্রি সার্ভিসিং সুবিধার কারণে দেশে উৎপাদিত এসির প্রতি গ্রাহকদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের সুবিধার্থে মাসিক কিস্তি, ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংক ঋণে এসি বিক্রি করছে।
বাজারে এখন দুই ধরনের এসি পাওয়া যায়। ইনভার্টার ও নন-ইনভার্টার। এর মধ্যে ইনভার্টারের দাম কিছুটা বেশি। তবে এ ধরনের এসিতে বিদ্যুৎ খরচ কম। পাশাপাশি এসিতে আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে। যেমন-ঘরের বাতাস জীবাণুমুক্ত রাখা, ভয়েস কন্ট্রোল, স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসি পরিষ্কার হওয়া ইত্যাদি। সাশ্রয়ী দামে আরও নানা সুবিধার এসি বাজারে ছাড়ছে দেশি কোম্পানিগুলো।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দাবদাহ, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় এসির প্রতি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ আগ্রহ চাহিদায় রূপান্তরিত হয়েছে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও এসি পৌঁছে গেছে। সরকারের নীতি সহায়তায় ইলেকট্রনিক্স শিল্প একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপে (আইএমএফ) কর ব্যয় কমিয়ে আনতে এনবিআর দেশি ইলেকট্রনিক্স শিল্পের কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে। এ সিদ্ধান্ত দেশের এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে। কেননা কর অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। তখন বাড়তি দামে এসি কেনার আগ্রহ হারাবে নিম্নবিত্তরা। চাহিদা কমে গেলে উৎপাদনও কমিয়ে আনতে বাধ্য হবে কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে রাজস্ব সুরক্ষা না পেলে বিদেশি এসির আমদানি বাড়বে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়বে। দেশ আবারও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। সব মিলিয়ে একদিকে বিনিয়োগ চাপে পড়বে, অন্যদিকে সরকার রাজস্ব হারাবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, চাহিদা থাকায় এসির গ্রে মার্কেট দিন দিন বড় হচ্ছে। রাজধানীর আশপাশে ছোট ছোট সংযোজন কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় নন-ব্র্যান্ডের এসি তৈরি হচ্ছে। মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোক্তাদের টার্গেট করে এরা এসি বানায়। এসব এসি কিনে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন। কেননা এসব প্রতিষ্ঠান বিক্রয়-পরবর্তী সেবা দিতে পারে না। অন্যদিকে সরকার রাজস্বও পাচ্ছে না। মিথ্যা ঘোষণায় এসব এসির পার্টস আমদানি করা হয়।
এ বিষয়ে যমুনা গ্রুপের গ্রুপ পরিচালক মনিকা নাজনীন ইসলাম বলেন, এক সময় এসিকে বিলাসী পণ্য বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এটি প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক্স পণ্য হয়ে উঠেছে। জীবনযাত্রার মান এবং সামগ্রিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার উন্নতির ফলে শহর থেকে গ্রাম অঞ্চলেও এসির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছর এসির বাজার ২০-২৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ক্রেতার কাছে উন্নতমানের এসি পৌঁছে দিতে যমুনা ইলেকট্রনিক্স উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে সব শ্রেণির মানুষের দোরগোড়ায় এসি পৌঁছে দিতে ১২ মাসের কিস্তি এবং ক্রেডিট কার্ডে শূন্য সুদে ব্যাংক ইএমআইতে এসি দিচ্ছে।
এলিট হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর এ আলম বলেন, আমদানির বিকল্প পণ্য হিসাবে স্থানীয় প্রস্তুতকারকরাই বাংলাদেশের এয়ারকন্ডিশনার শিল্পকে এতদূর এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশে শুধু এসির দাম কমছে এটা বড় কথা নয়, গত ১০ বছরে খুব কম ইন্ডাস্ট্রি আছে যারা বলতে পারবে পণ্যের দাম প্রতিবছর কমেছে, যারা গর্বের সঙ্গে বলতে পারবে দেশের মানুষের জন্য আমরা সাশ্রয়ী খরচে বিশ্বমানের পণ্য দিচ্ছি। আজ থেকে ২০ বছর আগে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, জাপানিজ এসির দাম বেশি, ঘর ভালো ঠান্ডা রাখে এবং দীর্ঘস্থায়ী। অন্যান্য এসি ভালো নয়, তাই দাম কম। কিন্তু আমার মনে হয় গত ১০ বছরে দেশের মানুষের এই পারসেপশনটা চেঞ্জ করতে পেরেছি।
