Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ

প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষকতা ক্লাসে চলছে পাঠদান

আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহারে পিছিয়ে শিক্ষকরা

হুমায়ুন কবির

হুমায়ুন কবির

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষকতা ক্লাসে চলছে পাঠদান

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে বড় সংকট মানসম্মত শিক্ষক। পাঠদানের গুণগত মান, শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়া, আচরণগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহার-সবকিছুর কেন্দ্রে শিক্ষকই অবস্থান করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষক অনেক প্রয়োজনীয় পেশাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াই করছেন শিক্ষকতা। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে এই ঘাটতি বেশ প্রকট। দেশে বাধ্যতামূলক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা বা ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের কোনো কাঠামো নেই। এর ফলে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহারে শিক্ষকরা পিছিয়ে পড়ছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব ও দলীয় বিবেচনায় অনেক শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। যাদের মধ্যে যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।

পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। আবার শিক্ষকদের বড় একটি অংশ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। উলটো পিঠে শিক্ষকদের জন্য সরকারের পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় অনেকেই অর্থকষ্টে জীবনযাপন করছেন। এমন এক বাস্তবতায় ‘শিক্ষকতা পেশা : মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকদের মধ্যে এখনো মুখস্থ ও পরীক্ষাভিত্তিক পাঠদানের প্রবণতা বেশি, যা শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা, মানসিক চাপ ও শেখার প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে শিক্ষকরাই অনেক সময় সঠিক বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। এর ফলে পড়াশোনায় ঝরে পড়ার হার বাড়ছে।

রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক আ ন ম সামসুল আলম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, দেশ ও জাতি পুনর্গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অপরসীম। তাই শিক্ষকতা পেশাকে নেশা হিসাবে নিতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী লাইনচ্যুত হয়, তাদের শাসন নয়, উৎসাহ দিয়ে ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। একজন শিক্ষক যতই মেধাবী হোন না কেন, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে তাকে নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কারণ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক মানেই মানসম্পন্ন শিক্ষা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত ও টেকসই করতে হলে শিক্ষক প্রশিক্ষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তা বাস্তবায়নে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি তাদের বেতন কাঠামোও সম্মানজনক করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু যুগান্তরকে বলেন, বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাবে বা টাকার বিনিময়ে অযোগ্য ও অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের অধিকাংশই শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অযোগ্য। এদের যাচাই-বাছাই করে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এসব শিক্ষকের আচার-আচরণ ও নীতি-নৈতিকতা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে তারা যথাযথ সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন দেখা যায়, প্রাথমিক ও সমপর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি ১ লাখ সাড়ে ১৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক রয়েছেন ৬২ লাখ ৬ হাজার ৪২ জন। মাধ্যমিক (সমপর্যায়), কলেজ (সমপর্যায়), মাদ্রাসা, কারিগরি, সব সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়/বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ৪ লাখ ৫ হাজার ৬২৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬৪ লাখ ৬ হাজার ৩৯ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক রয়েছেন ৮২ হাজার ৫০৬ জন। বাকিরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মোট শিক্ষকের মধ্যে নারী শিক্ষক রয়েছেন ১৮ লাখ ২ হাজার ২৮৮ জন, যা মোট শিক্ষকের ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না শিক্ষকরা। এ প্রযুক্তিগত অদক্ষতা শিক্ষার্থীদের শেখার মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্য দেশগুলোয় শিক্ষক প্রশিক্ষণকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। যেমন ফিনল্যান্ডে শিক্ষকরা মাসে গড়ে ১৫ ঘণ্টা পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। জাপানে এটি বাধ্যতামূলক ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। ভারতে সম্প্রতি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণকে আরও বিস্তৃত ও অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে।

পটুয়াখালী জেলার দক্ষিণ বগা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইয়াসমিন সুলতানা বিথী যুগান্তরকে বলেন, বাধ্যতামূলক শিক্ষক প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে। বিশেষ করে নিয়োগের আগে ও পরে। নিয়মিত ও ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম চালু করে অনলাইনভিত্তিক প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের আলাদা সিলেবাস তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য যৌক্তিক বেতন বাড়াতে হবে এবং নীতিগত সদিচ্ছা নিশ্চিত করতে হবে। জাতি গঠনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের ভূমিকা অতুলনীয়।

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস : ১৯৯৪ সাল থেকে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর দিবসটি উদযাপিত হয়। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য-‘শিক্ষার পুনরুদ্ধারে শিক্ষকরাই মূল চালিকাশক্তি’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ দিবসটি পালিত হচ্ছে। অন্য বছরের মতো এবারও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উপলক্ষ্যে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীন। এছাড়া বিশেষ অতিথি থাকবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, ইউজিসির চেয়ারম্যান ড. এসএমএ ফয়েজ, ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের প্রধান ড. সুসান ভাইজ এবং সম্মানিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন ইসলামিক ওয়ার্ল্ড এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (আইসেসকো)-এর মহাপরিচালক ড. সালিম এম. আলমালিক। দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।

দিবসটি পালনে দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এছাড়া দিবসটি উদযাপনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন র‌্যালি ও আলোচনা সভা এবং সেমিনার আয়োজন করার উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শিক্ষকের মর্যাদা ও মানসম্পন্ন শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষকের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করা, শিক্ষকদের অধিকার সম্পর্কে জানানো, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা এবং প্রবীণ শিক্ষকদের অভিজ্ঞতাকে জানা ও কাজে লাগানোই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। দিবসটি উপলক্ষ্যে ১২ গুণী শিক্ষককে সম্মাননা দেওয়া হবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম