Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিশ্ব ডাক দিবস আজ

দুর্নীতি অনিয়ম লোকসানে ডাক সেবা তলানিতে

অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে গঠিত টাস্কফোর্স শ্বেতপত্র প্রকাশে কাজ করছে * করপোরেট ও সরকারি চিঠিপত্র লেনদেন বেড়েছে

আমিরুল ইসলাম

আমিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্নীতি অনিয়ম লোকসানে ডাক সেবা তলানিতে

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ

বিগত সরকারের সময় ডাক বিভাগে অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, তহবিল তছরুপ ছিল ওপেন সিক্রেট। এর ওপর আছে রাষ্ট্রীয় এই সেবা প্রতিষ্ঠানটির ধারাবাহিক লোকসান। ফলে ডাক বিভাগের ওপর গণমানুষের আস্থা ও সেবা তলানিতে ঠেকেছে। ডাক সঞ্চয় ব্যাংকের গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং সাড়ে ৮ হাজার ডিজিটাল আধুনিক পোস্ট অফিস স্থাপনের নামে প্রকল্প পরিচালক থেকে মহাপরিচালক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সুধাংশু শেখর ভদ্রের দুর্নীতিতে ডাক বিভাগটি ডুবতে বসেছিল। এছাড়া ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দুর্নীতি ও পাচারের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক। সুধাংশু শেখরকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও পোস্টমাস্টার জেনারেল মোস্তাক আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মোস্তাকের বিরুদ্ধে ১৫ কোটি ১১ লাখ টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। একাধিক কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে টাস্কফোর্স গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুদক তদন্ত করছে ডাক বিভাগের দুর্নীতি। এদিকে ব্যক্তিপর্যায়ে চিঠিপত্র, মানি অর্ডার সেবা তলানিতে ঠেকলেও করপোরেট এবং সরকারি চিঠিপত্রের লেনদেনের সেবা বেড়েছে। এ অবস্থার মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডাক দিবস।

দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘জনগণের জন্য ডাক-স্থানীয় পরিষেবা বৈশ্বিক পরিসর’। এ উপলক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা তার বাণীতে ডাক বিভাগকে বার্তা আদান-প্রদানের মধ্যে সীমিত না রেখে এটিকে অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসাবে রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

দিবস উপলক্ষ্যে বিকালে আগারগাঁও ডাক ভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার ডাক ও টেলিযোগাযোগবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, দেশের ঠিকানা ব্যবস্থাপনা পুরোনো রয়ে গেছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের আদলে চলছে ঠিকানা ব্যবস্থাপনা। এসব দিয়ে হবে না। ডাক বিভাগের আধুনিকায়নের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের ঠিকানা ব্যবস্থাপনায় নতুন ধারার প্রবর্তন করা হবে। সেক্ষেত্রে সরকার ডাক আইন সংশোধন করে হালনাগাদ করবে। তিনি বলেন, ই-কমার্সকে একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসব। এটা ডাক বিভাগ থেকে ব্যবস্থাপনা করা হবে। ই-কমার্সের মাধ্যমে গত সরকারের সময় হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে ই-কমার্স নিয়ে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, জীবনবিমা সেবা ও ডাক সঞ্চয়পত্র সেবা দেবে ডাক বিভাগ। গত বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করেছে ডাক বিভাগ। পোস্টাল ব্যালটে ভোট নেওয়া সংক্রান্ত এক প্রশ্নে এই বিশেষ সহকারী বলেন, ব্যালটের নিরাপত্তায় টু ইনব্লাপ সিস্টেম নেওয়া হয়েছে।

অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আব্দুন নাসের খান যুগান্তরকে বলেন, সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে গঠিত টাক্সফোর্সের কাজ হচ্ছে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। সেখানে দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অধুনিক ডাকাঘর স্থাপনে ৫৯৪ কোটি ১২ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন সুধাংশু শেখর ভদ্র। একপর্যায়ে তিনি মহাপরিচালক (ডিজি) হন। তার সময়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে বাধ্যতামূলক আবসরে পাঠায় গত সরকার। কিন্তু সরকারি অর্থ আদায়ে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি তৎকালীন সরকার। অধুনিক পোস্ট অফিস স্থাপন প্রকল্পের কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে পোস্টমাস্টার জেনারেল মোস্তাক আহমেদকে গ্রেফতার করেছে দুদক। অবশ্য পরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন।

দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরীতে ডাক সঞ্চয় ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। টট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল ও নাটোরে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়েছে। সংশ্লিষ্ট পোস্টমাস্টারসহ একাধিক কর্মচারী এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হলেও তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক চিঠিপত্র ও পার্সেল, সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-সরকারি, স্বশাসিত এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চিঠিপত্র গ্রহণ ও প্রেরণ হয় ডাক বিভাগ থেকে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানও চিঠিপত্র ও পার্সেল প্রেরণ-গ্রহণে ডাক বিভাগের সেবা নিচ্ছে। এছাড়া ডাক বিভাগের মাধ্যমে সরকারের গোপন নথি এবং পার্সেলগুলো গ্রহণ ও প্রেরণ হয়ে থাকে। ফলে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ডাক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অধিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমনকি জনবল সংকটের দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

নগদের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দুর্নীতি ও পাচারের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার পাচার এবং ৬০০ কোটি টাকার ই-মানি সংক্রান্ত অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। নগদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও এটি স্বীকার করেছেন।

ডাক বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিগত সরকারের সময় ডাক বিভাগ ব্যবহার করে বিধিবহির্ভূতভাবে ডিজিটাল অর্থ লেনদেন প্ল্যাটফর্ম নগদ চালু করে একটি চক্র। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন, সাবেক এমপি নাহিম রাজ্জাক, রাজি মোহাম্মদ ফকরুলসহ প্রভাবশালী চক্র এ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। খোকন তার স্ত্রী নূপুরের নামে ৫০০ শেয়ার নিয়েছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও তার দোসররা পালানোর পর নগদের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। কথা হয় বিভাগের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানান, ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স ট্রান্সফার, ব্যাংকিং সেবা ও ডাক জীবনবিমা সেবা দেবে ডাক বিভাগ। বর্তমানে শুধু ডাক সঞ্চয় ব্যাংক ও জাতীয় সঞ্চয়পত্র সেবা প্রদান করছে ডাক বিভাগ। সরকার চাইলে সেবা আরও বাড়ানো সম্ভব। এখনো সংস্থাটির ১ কোটি ২৯ লাখ গ্রাহক রয়েছে। গত অর্থ বছর ডাক বিভাগের লোকসান হয়েছে-প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম