চলনবিলে নৌকার স্কুল ছড়াচ্ছে জ্ঞানের আলো
প্রতিষ্ঠাতা পেলেন ইয়েল ইউনিভার্সিটি ফেলোশিপ
গুরুদাসপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্বে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে চলেছে চলনবিলের পানিতে ভাসা নৌকার স্কুল। বর্ষাকালে নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার চলনবিলে নৌকার স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং সফলভাবে পরিচালনা করায় ‘ইয়েল ইউনিভার্সিটি মরিস আর. গ্রিনবার্গ বিশ্ব ফেলোশিপ-২০২৫’ পেয়েছেন স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান। প্রতিবছর ১৬ জন উদীয়মান তরুণকে এ মর্যাদাপূর্ণ ফেলোশিপ দেওয়া হয়। ২০২৫ সালে বিশ্বের ৪ হাজার ২০০ জন এর জন্য আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে নাটোরের গুরুদাসপুরের সাবেক এমপি মরহুম মোজাম্মেল হকের ছেলে রেজওয়ান সেই নির্বাচিত ১৬ জনের অন্যতম হিসাবে ফেলোশিপ পেয়েছেন। বন্যাপ্রবণ চলনবিল অঞ্চলে জন্ম নেওয়া রেজওয়ান আজ গ্রামের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসীমায় তার দ্যুতি ছড়িয়েছেন।
রেজওয়ান বলেন, নতুন কোনো সমাধান বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে আসতে পারে। আশা করি, ইয়েল ইউনিভার্সিটির এই স্বীকৃতি আমাদের অর্জনকে বৈশ্বিক পর্যায়ে আরও ছড়িয়ে দেবে।
নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ চলনবিল এলাকায় বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে রেজওয়ান নৌকাভিত্তিক স্কুলের ধারণা নিয়ে আসেন। তার ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই স্কুলের যাত্রা শুরু হয় ২০০২ সালে। প্রথম ভাসমান স্কুলটি ছিল একটি ছোট নৌকা, যেখানে কয়েকটি বই, শিক্ষাসামগ্রী এবং শিক্ষক থাকতেন। এক্ষেত্রে নদী বা বন্যার পানি কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। শত শত শিশু শিক্ষালাভ শুরু করে, আর এক বছরের মধ্যেই তাদের আগ্রহ বেড়ে যায়। তাদের ফলাফলও হয় চমকপ্রদ।
পরবর্তীতে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে ভাসমান স্কুলগুলোতে সংযোজন করা হয় ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, চিকিৎসাসেবা ও কৃষি খামারিদের সহায়তা কেন্দ্র। রেজওয়ান বলেন, শিশুদের মুখে প্রথম হাসি দেখার মুহূর্তটা কোনো পুরস্কারের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।
রেজওয়ানের উদ্ভাবিত ভাসমান স্কুলের ধারণা ইতোমধ্যে জাতিসংঘের ইউনিসেফ, ইউএনইপি ও ইউএনডিপির স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৯ সালে ব্রিটিশ প্রকাশনা ‘আর্থ হিরোজ’ তাকে বিশ্বের ২০ জন ‘আর্থ হিরো’র একজন হিসাবে উল্লেখ করেছে। তার মডেল এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রেজওয়ান বলেন, এই ফেলোশিপ আমাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুন ধারণা গ্রহণ এবং নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। আমি চাই, আমাদের মডেল বিশ্বের অন্যান্য বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হোক।
এ ভাসমান স্কুল মডেল শুধু বাংলাদেশের শিশুদের জন্য নয়। এটি এরই মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া জাম্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও এই মডেলকে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষক এবং অভিভাবকরা একসঙ্গে কাজ করে প্রতিটি ভাসমান স্কুল পরিচালনা করছেন। চলনবিলের শিক্ষার্থী মিমি (১২) বলেছে, আগে বর্ষায় আমরা স্কুলে আসতে পারতাম না। এখন নৌকা স্কুল আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। আমরা লেখাপড়া করি, গান গাই এবং খেলা করি। এটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। আরেক শিক্ষার্থী আলম (১৩) বলেছে, ভাসমান স্কুল আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। আমরা জানি, বন্যা হলেও শিক্ষিত হওয়া সম্ভব। রেজওয়ান স্যার আমাদের শিক্ষক, বন্ধু আর পথপ্রদর্শকও বটে।
রেজওয়ান এখন ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে চার মাসের ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশ নেবেন। সেখানে তিনি বৈশ্বিক নেতাদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবেন, অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন এবং ভাসমান স্কুল মডেলের উন্নয়ন ও বিস্তার নিয়ে নতুন ধারণা গ্রহণ করবেন। ফেলোশিপের মাধ্যমে তিনি বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থা, জলবায়ু অভিযোজন নীতি ও সামাজিক উদ্ভাবন নিয়ে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করবেন। এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে মডেলের মান যাচাই ও সম্প্রসারণের জন্য অংশীদারিত্ব গড়ে তুলবেন।
২০০২ সাল থেকে শুরু হওয়া মরিস আর. গ্রিনবার্গ বিশ্ব ফেলো প্রোগ্রাম হচ্ছে ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল লিডারশিপ সেন্টারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। একটি বিশেষ প্ল্যাটফর্ম হিসাবে পরিচিত এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের প্রভাবশালী নেতাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই ফেলোশিপে অংশগ্রহণকারীদের অনেকে পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এর মধ্যে রয়েছেন রাশিয়ার দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতা আলেক্সেই নাভালনি, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান, আর্জেন্টিনার সাবেক অর্থ ও উৎপাদন মন্ত্রী মার্টিন লুস্তু এবং লিচেনস্টাইনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাটরিন এগেনবার্গার।
