জাহানারার আর্জি স্যার, আমাকে বাঁচান
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘আমাকে মানসিক টর্চার থেকে বাঁচান স্যার!’-এ আকুতি বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সদস্য জাহানারা আলমের। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজনের কাছে যে অভিযোগনামা জমা দিয়েছিলেন, তাতে ছিল এ আর্জি। ২০২২ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগে ওই অভিযোগ করেছিলেন জাহানারা। ১৩ পৃষ্ঠার দীর্ঘ ওই আবেদনে অবশ্য মন গলেনি সিইও-এর। বিসিবি বা তিনি এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
জাহানারা বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার অন্যতম সৈনিক। একসময় বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের পোস্টার গার্ল ছিলেন। ছিলেন নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়কও। ওই অভিযোগনামায় নানা ইঙ্গিত দিলেও সরাসরি যৌন হররানির প্রসঙ্গ টানেননি জাহানারা। তবে অনিয়মের নানা তথ্য তুলে ধরলেও সিইও-এর মতো একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সে বিষয়ে নজর না দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অভিযোগনামাটির কপি যুগান্তরের হাতে এসেছে। এতে আলোচনায় যে দুটি নাম বেশি এসেছে তা হলো-তৌহিদ মাহমুদ ও মঞ্জুরুল ইসলাম। দুজনই নিজামউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ। একটি সূত্র জানিয়েছে, এই অভিযোগ পাওয়ামাত্রই তৌহিদকে তা পাঠিয়ে দেন নিজামউদ্দিন। এরপর থেকে আরও বেশি সরাসরি ও মানসিক নির্যাতন চলতে থাকে জাহানারার ওপর। একপর্যায়ে দেশই ছাড়েন তিনি।
জাহানারার অভিযোগের শেষ পৃষ্ঠার একটি অংশ যুগান্তরের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। এতে বলা হয়েছে-‘আমাকে মানসিকভাবে (মেন্টালি) টর্চার থেকে বাঁচান দয়া করে স্যার, কীভাবে দল গঠন হবে, কাকে অধিনায়ক করা হবে, কারা কোচিং স্টাফে থাকবে, কারা অফিশিয়াল থাকবে, তা সম্পূর্ণ বিসিবির ব্যাপার। আমি শুধু আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুটা লিখে জানালাম। আমি শুধু আমার দেশের জন্য পারফর্ম করতে চাই স্যার।’ তিনি আরও লেখেন, ‘এটা কোনো অভিযোগ নয় স্যার, এটা একটা নোট। ভবিষ্যতে যদি কোনো কঠিন পরিস্থিতির কবলে পড়ি, তো আমার বিশ্বাস, আমার বিসিবি অভিভাবক, আমাকে সাহায্য করবেন ইনশাআল্লাহ।’
জানাহারা লেখেন, ‘একটা বিশেষ অনুরোধ স্যার, যদি কোনো খেলোয়াড় বা কোনো অফিশিয়াল আমার সম্পর্কে কোনো নেগেটিভ কথা বলে তো দয়া করে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করবেন স্যার। আমি সত্য কথা বলব স্যার, ইনশাআল্লাহ। আমি সব সময় সৎ থাকার চেষ্টা করি স্যার। অনেক ধন্যবাদ স্যার ধৈর্য নিয়ে আমার লেখা পড়ার জন্য। দয়া করে বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখবেন স্যার।’
জাহানারা তার অভিযোগটি সিইও বরাবর দিয়েছেন, আকুতি জানিয়েছেন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনার। তিনি জাতীয় দল ও আশপাশের সবকিছু নিয়ে লেখেন। নারী দলের মধ্যে কী হচ্ছে, কারা প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন-সবকিছু তুলে ধরেছেন। কয়েকটি ঘটনা দিন-তারিখ দিয়েও উল্লেখ করেছেন তিনি।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় এক জায়গায় লিখেছেন, ‘তারা দুজনেই (তৌহিদ ও সরফরাজ বাবু) আমার সঙ্গে মেন্টাল গেম খেলা শুরু করেন।’ পৃষ্ঠাটির শুরু এভাবে-“বাবু (সরফরাজ) ভাই বলেন, ‘দেখেন আপা সামনে অনেক টুর্নামেন্ট আপনাদের। এক হয়ে খেলতে হবে। টিমে কোনো ঝামেলা থাকলে নিজেরা ঠিক করে ফেলেন। তৌহিদ ভাই অনেক চেষ্টা করছেন। তৌহিদ ভাই নিজেও খুব চাপে আছেন। হয়তো জব ছেড়ে দিতে পারেন। আপনি আবার এগুলো কারোর সঙ্গে শেয়ার করবেন না।’ আমি বললাম, ‘ভাই, তৌহিদ ভাই সব সমস্যা সম্পর্কে অবগত। সুতরাং উনি চাইলেই নিজে সব ঠিক করতে পারবেন। আর আমি দলের জন্য সব সময় নিবেদিতপ্রাণ। আমার কোনো সাহায্য লাগলে বলবেন, আমি প্রস্তুত আছি।’ ব্যস, এ কথা হওয়ার পরদিন থেকে মঞ্জু (মঞ্জুরুল ইসলাম) ভাই আমার সঙ্গে মাঠে খারাপ ব্যবহার শুরু করলেন অকারণে। খুব চিৎকার এবং রূঢ়ভাবে কথা বলা শুরু করলেন। আমি হকচকিত। বুঝলাম না আমার অন্যায়টা কী? পরদিন তৌহিদ ভাইকে ফোন করলাম ইন্টারভিউয়ের অনুমতির জন্য, ফোন না ধরায় এসএমএস করলাম, রিপ্লাই পেলাম না। এভাবে চলতে থাকল। একসময় বুঝলাম তারা দুজনই আমার সঙ্গে মেন্টাল গেম খেলছেন।”
তৃতীয় পৃষ্ঠায় এক জায়গায় লিখেছেন, “মঞ্জু ভাই বলেন, ‘খবরদার জাহানারাকে যেন আর কখনো বল না দেওয়া হয়।” একটা জায়গায় লিখেছেন, ‘৩১ মার্চ (২০২১) রাত ১১টা ৩০ মিনিটে বাবু ভাই আমাকে ফোন করে বলেন কেকের অর্ডার (জাহানারা তার জন্মদিনের কেকের অর্ডার দিয়েছিলেন) বাতিল করতে হবে!’ অথচ পরে সবার জন্মদিন ভালোভাবে উদযাপন হয়েছে।’ লেখা আছে-‘তৌহিদ ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া মঞ্জু ভাই কোনো কাজ করেন না।’ অথচ সামনা-সামনি দুজন দুজনের দোহাই দেন। কোবরা, টুম্পা, লতা, সুপ্তা মুখ খুলতে ভয় পায়। জ্যোতি, পিংকি ওরা খারাপ সম্পর্ক করবে, উলটাপালটা কাজ করবে এমনকি ছেলে বা মেয়ে কোচের ক্লোজ হয়ে অন্যের নামে কোচদের কান ভারী করবে, ভুক্তভোগী আমি ও আমরা।’ এরকম ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ও উঠে এসেছে ওই অভিযোগপত্রে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিবির সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট বিভাগে এবং তাদের জানানো। আমি চিঠিটা পাওয়ার পরই ওই বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি।’

