Logo
Logo
×

শেষ পাতা

গুলিবিদ্ধ চোখে সন্তানের মুখ হাতড়ে বেড়ান রায়হান

Icon

মনিকা চৌধুরী, বরিশাল

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গুলিবিদ্ধ চোখে সন্তানের মুখ হাতড়ে বেড়ান রায়হান

একমাত্র সন্তান ইলাফকে স্পষ্ট করে দেখতে পান না। তাই হাত দিয়ে অবয়ব বোঝার চেষ্টা করছেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুলিতে চোখ হারানো বরিশালের রায়হান -যুগান্তর

অস্পষ্ট চোখে দু’হাতে হাতড়ে সন্তানের মুখের অবয়ব বোঝার চেষ্টা করেন রায়হান। পুরো নাম আসাদুজ্জামান রায়হান। আগস্টের জনযুদ্ধে হারিয়েছেন এক চোখ। অন্য চোখে রয়ে গেছে ঘাতকের রাবার বুলেট। সঠিক চিকিৎসার অভাবে সেই চোখটায়ও একটু একটু করে হারাচ্ছে আলো। তাইতো জুলাই বিপ্লবের পর জন্ম নেওয়া একমাত্র সন্তান ইলাফকে স্পষ্ট করে দেখা হয়নি তার। আবছা চোখে হাতড়ে চলে অবয়ব বোঝার চেষ্টা। সবাই বলে ছেলে নাকি বাবার মতোই হয়েছে। অন্ধকার নেমে আসা আবছা চোখ আর হাতের অনুভূতিতে সেটাই বোঝার চেষ্টা চলে রায়হানের।

সরকার পতনের ঠিক আগের দিন ৪ আগস্ট সকাল। বরিশালেও তখন উত্তাল আন্দোলন। ভোরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে বের হয়েছিলেন রায়হান। বলেছিলেন, আত্মীয়ের বিয়েতে যাবেন। কিন্তু যে পথে পা বাড়ান, তা ছিল আন্দোলনের উত্তপ্ত রণক্ষেত্র।

আন্দোলনকারীদের ওপর তখন চলছে টিয়ারশেল আর রাবার বুলেট নিক্ষেপ। জীবন বাঁচাতে রায়হানসহ অনেকে আশ্রয় নেন হাতেম আলী কলেজের ভেতরে। ঠিক তখনই পুলিশের ছোড়া একটি রাবার বুলেট সোজা এসে লাগে রায়হানের ডান চোখে। মুহূর্তেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। তিনি বুঝে ফেলেন চোখটি আর কখনও ফিরবে না, হয়তো তিনিও আর ফিরবেন না পরিবারের কাছে। দেখা হবে না অনাগত সন্তানের মুখ।

সহযোদ্ধারা রায়হানকে দ্রুত নিয়ে যান হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে শুরু হয় আরও একটি দুঃসহ অধ্যায়। জরুরি চিকিৎসা তো দূরের কথা, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর তার জোটে শুধু সামান্য ব্যান্ডেজ। চিকিৎসা না পেয়ে কাতরানো সেই মুহূর্তগুলো আজও রায়হানের মনে দগদগে স্মৃতি।

পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় রায়হানকে নিয়ে স্ত্রী বাবুনি লুকিয়ে চলে যান ঢাকায়। সেখানেই শুরু হয় তার চিকিৎসা। ডাক্তাররা জানিয়ে দেন ডান চোখ আর ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আরও ভয়াবহ খবর ছিল বাম চোখটিও ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাওয়ার শংকা। চিকিৎসার খরচ বহনের কোনো সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। তখন তার স্ত্রী নিজের গয়না বন্ধক রাখেন। রায়হানের শ্বশুরবাড়ি থেকেও জোগানো হয় চিকিৎসার খরচ। এরপর যুগান্তরসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রায়হানের অসহায় অবস্থার খবর ছড়িয়ে পড়লে আসে সহায়তার কিছু অর্থ। সেই টাকা দিয়েই তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন এখন সিলিকন ও ওষুধ দিয়ে তার চোখের শেপ ধরে রাখা হয়েছে। কিছুদিন পর ক্ষতিগ্রস্ত চোখটি অপসারণ করে বসানো হবে কৃত্রিম চোখ। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বাম চোখটি কতদিন ভালো থাকবে, সে বিষয়ে চিকিৎসকরা বলতে পারছেন না কিছুই।

জুলাই যোদ্ধা রায়হান বলেন, এখন এক চোখ দিয়ে দুনিয়াটা ঝাপসা দেখি। জানিনা আমার এই চোখটি আর কতদিন এভাবে থাকবে। যে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল, তা পাইনি। সরকার থেকে বলেছিল, আমাদের উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হবে। আফসোস, তা পাইনি। চোখ না থাকলে মানুষটা কীভাবে বেঁচে থাকে?

এত সব কঠিন পরিস্থিতিতে স্ত্রী বাবুনি ছিলেন রায়হানের একমাত্র শক্তি। কাঁধ ধরে সাহস দিয়েছেন, চিকিৎসার খরচ জোগাড় করেছেন, বিপদের মধ্যে লুকিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছেন। নিজের জীবনযুদ্ধের বর্ণনায় প্রতিটি বাক্যেই ফুটে ওঠে তার কৃতজ্ঞতা। তিনি বলেন, আমি বেঁচে আছি আমার স্ত্রীর জন্য, আমার ছেলের ভবিষ্যতের জন্য। আমার স্ত্রী না থাকলে হয়তো আমি বাঁচতেই পারতাম না।

রায়হানের সহধর্মিণী বাবুনি বলেন, ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। এখন ওর একটা চোখ নেই, ভবিষ্যতেও অন্ধ হয়ে যেতে পারে-এসব জেনে কি ওকে ছেড়ে দিব? সে আমার সন্তানের বাবা। আমার সন্তান পিতৃসুখে বড় হোক আমি এটাই চাই। আমি প্রথমে আমার পরিবারকেও জানাইনি, ভয় ছিল রায়হানের থেকে আমাকে তারা যদি আলাদা করে ফেলে! অনেকে তো বলেছিল সন্তান নষ্ট করে দিতে। আমি হাল ছাড়িনি। ২ মাসের ছোট সন্তান অসুস্থ স্বামী নিয়ে টানাপোড়েনে সংসার চলছে।

নিজের অপারগতা নিয়ে দুঃখ করে রায়হান বলেন, আমি সংসারের একমাত্র ছেলে, আমার ২টি বোনের বিয়ে হয়েছে। এখন আমার পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা। সেখানে আমি এখন সংসারের বোঝা। আমি যেহেতু চোখে দেখিনা। আমাকে কেউ কাজ দেয় না। আমার শ্বশুর, আমার বাবা আমাদের সংসারটা টানছেন। জুলাই ভাতাটা এখন বন্ধ। এককালীন কিছু টাকা পেয়েছিলাম, তা দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হয়। ওর জন্য কিছু করতে পারছিনা। দেশ নিয়ে ভেবেচিন্তে আহত যোদ্ধা রায়হান বলেন, স্বৈরাচার হটাতে গিয়ে এক চোখ হারিয়ে অন্ধ হতে বসেছি, তবুও যদি আমার এক চোখ দিয়েই দেখতাম, আমার দেশটা ভালো আছে। যে আশা নিয়ে রাজপথে নেমেছিলাম, সেই আশা পূরণ হয়েছে, তাহলে শান্তি পেতাম। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হয়নি। এই কষ্ট, এই আক্ষেপই বা কোথায় লুকাই! তবুও রায়হান হাতড়ে হাতড়ে ছেলের মুখ খোঁজেন। সেই স্পর্শে তিনি খুঁজে পান বেঁচে থাকার কারণ। অন্ধকার চোখের ভেতর জমে থাকা যন্ত্রণা, দুঃসহ স্মৃতি আর স্বপ্নভাঙা জীবন-সবকিছুর মাঝেও তিনি বেঁচে আছেন, কারণ এখনও আশা আছে একটি স্বাধীন ভবিষ্যতের।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম