গৌরবময় মহান মুক্তিযুদ্ধ
জুলুম অত্যাচারমুক্ত দেশ দেখে যেতে চাই: বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হক খান
এসএম পারভেজ, পিরোজপুর
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সামছুল হক খান
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকার জগন্নাথ কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন শামছুল হক খান। তারুণ্যের উন্মাদনা আর প্রতিশোধের আগুন তাকে বারবার রণাঙ্গনে টানছিল। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি। অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। যুগান্তরকে বীর মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক খান বলেন, ‘মৃত্যুর আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ, জুলুম-অত্যাচার ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন বাংলাদেশ দেখে যেতে চাই।’ একাত্তরের স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে শামছুল হক খান বলেন, কালক্ষেপণ না করে বিভিন্ন পথ বেয়ে রাতে পিরোজপুরের নিজ বাড়ি কলাখালীতে পৌঁছি। সেখান থেকে কয়েকজনকে সংগ্রহ করে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে বেরিয়ে পড়ি। পালিয়ে যশোরের ভদ্রপাড়ায় পৌঁছে মাঠের পর মাঠ ধানখেত ও আমবাগানের অলিগলি পথ ধরে যশোরের নদী পার হয়ে ভারতের বনগাঁও সীমান্তে পৌঁছি নৌকায় চড়ে। আমার সঙ্গে ১৪-১৫ জনের একটি দল ছিল। এ সময় আমরা পাক সেনাদের আক্রমণের শিকার হলেও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। বনগাঁও পৌঁছলে সেখানে পিরোজপুর শহরের পরিচিত দিলীপের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাদের ‘বেগুনদিয়া’ মুক্তি ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছে দেন। এই ক্যাম্পে অন্তত ১৫০ জনের একটি গ্রুপকে বিভিন্ন অস্ত্রের ওপর প্রশিক্ষণ দেন সেখানকার ট্রেইনাররা। প্রশিক্ষণ শেষে ভারত থেকে এই গ্রুপকে নৌকায় সুন্দরবনের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন রাত শুধু শুরু। মাঝ নদীতে নৌকা পৌঁছতে না পৌঁছতেই আগে থেকে সুন্দরবনে অবস্থান নেওয়া পাক সেনারা আমাদের নৌকা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। কয়েকজন যোদ্ধা গুলিতে আহত হন। এ সময় তারা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেন এবং নিজেদের জেলে হিসাবে পরিচয় দিয়ে সুকৌশলে সুন্দরবনের গহিনে প্রবেশ করেন।
অশীতিপর বীর মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক খান যুগান্তরকে আরও জানান, এ সময় গহিন জঙ্গলের দিকভ্রান্ত পথের কোনো দিশা না পেয়ে তারা হাঁটতে থাকেন মাইলের পর মাইল। একপর্যায়ে এক মৌয়ালীর সঙ্গে দেখা হয়। তার কাছ থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের কথা জানতে পেরে সে পথে হাঁটতে থাকেন। ঘণ্টা তিনেক হাঁটার পর সন্ধান মেলে সেই ক্যাম্পের। তখন বাগেরহাট, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরার একাংশ নিয়ে গঠন করা হয় সাব-সেক্টর। মেজর জিয়া উদ্দিন ছিলেন এর কমান্ডার। তেঁতুলবাড়িয়া নদীর তীরে সুন্দরবনের সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স গড়ে তোলা হয়। সেনাবাহিনীর নিয়মানুসারে পরিচালিত এই বাহিনীতে মোট ১২টি প্রশাসনিক বিভাগ ও বিশেষ গেরিলা বাহিনী ছিল।
মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক আরও জানান, তাম্বুলবুনিয়া স্টুডেন্ট ক্যাম্প, হয়লাতলা ও কলমতেজিতে ছিল সুন্দরবন বাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির। শামছুল হক ছিলেন স্টুডেন্ট ক্যাম্পের দায়িত্বে। এখানে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণ কাজে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত এবং পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ ও পাক সেনা ক্যাম্পগুলোর বিরুদ্ধে অপারেশনে লিপ্ত করার দায়িত্ব পালন করেন। শামছুল হক খান এ সময় বিশেষ-বিশেষ ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন এবং পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।
তখন বিভিন্ন মুক্তি ক্যাম্পের মধ্যে কলমতেজি ক্যাম্পে স. ম. কবির আহমেদ মধু, নারী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নাছিমা বেগম, নাংলী ক্যাম্পে মফিজুল হক, তাম্বুলবুনিয়া পশ্চিমবঙ্গ গেরিলা ক্যাম্পে সুবেদার আ. গাফফার, হয়লাতলা ক্যাম্পে মো. আফজাল হোসেন, বৈদ্যমারি মুজিব বাহিনী ক্যাম্পে ডা. মোসলেম উদ্দিন এবং কালীবাড়ি ক্যাম্পে নূর মোহাম্মদ দায়িত্ব পালন করেন। সাব-সেক্টর হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর (মেজর) জিয়া উদ্দিন জিয়া বাহিনী হিসাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বেশকিছু উন্নত অস্ত্র পায়। জিয়া বাহিনী পিরোজপুর ও বাগেরহাটের সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চলসহ সমগ্র সুন্দরবন এলাকায় শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এ সময় জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে এ বাহিনী অনেক যুদ্ধ ও অপারেশনে অংশ নেয়। এর মধ্যে মোরেলগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, ধানসাগর খালমুখে সম্মুখযুদ্ধ, ফুলহাতা পানগুচি নদীতে রাজাকার বাহিনীর লঞ্চ আক্রমণ, মোরেলগঞ্জে রাজাকারদের বিরুদ্ধে অভিযান, বগী পাঞ্জাবি গানবোট প্রতিরোধ যুদ্ধ, রাজাপুর ভোলা নদীর পূর্ব পাড়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ, তুষখালী অপারেশন, বড় মাছুয়ায় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মঠবাড়িয়া-আমড়াগাছিয়া-বেতমোর যুদ্ধ, শরণখোলা হানাদার বাহিনীর গানবোট প্রতিরোধ, শৌলা নদীপথে পাক বাহিনীর গানবোট আক্রমণ, শেলা নদীতে পাক বাহিনীর স্টিমার আক্রমণ, বগী ঘাঁটিতে হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ, পাঞ্জাবি গানবোটে হামলা, শাপলেজা বাজার অপারেশন, হিরণ পয়েন্ট-মর্জাদ-মোংলাবন্দর অভিযান, কাউখালী উপজেলায় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশন ও মঠবাড়িয়া উপজেলা অভিযান উল্লেখযোগ্য।
৮ ডিসেম্বর জিয়া বাহিনীর হাতে পিরোজপুর শত্রুমুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্তে ১২ ডিসেম্বর মেজর জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে সুন্দরবন ছেড়ে আসার সময় মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক খানসহ অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধা রায়েন্দা, মোরেলগঞ্জে অবস্থানরত পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং একপর্যায়ে পাক বাহিনী পিছু হটে পলায়ন করে। ঘরে ঘরে তোলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা।
