বেচারাম দেউড়ির কাশ্মীরি শাহ’র মাজার
নজরুলের স্মৃতিতে ভাস্বর স্থানটি সংরক্ষণের দাবি
বাংলা ভাষার প্রথম গজল ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ এর মতো গান রচনা করেছিলেন এখানে বসেই
শাহবাগ (ঢাকা) সংবাদদাতা
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়িতে কাশ্মীরি শাহ সাহেবের মাজার। সোমবার তোলা -যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়িতে অবস্থিত কাশ্মীরি শাহ সাহেবের মাজার ঘেরা বাগিচাবাড়ি, যেখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিবিড়ভাবে জীবনের কিছুটা সময় কাটিয়েছেন। এখানে তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রথম এবং জনপ্রিয়তায় ধন্য বিখ্যাত গজল ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ বেচারাম দেউড়ির বাগানবাড়ির বাগিচায় বসেই তিনি লিখেছিলেন। সেই বাগিচার কোনো অবশিষ্টাংশ এখন আর নেই। সময়ের আবর্তে দখলদাররা ঐতিহাসিক স্থানটি দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র ও বসতি গড়ে তুলেছে।
কবি নজরুল প্রথমবার বেচারাম দেউড়িতে আসেন ১৯২৬ সালের অক্টোবরে, স্বরাজ দলের হয়ে নির্বাচন করার জন্য। ঢাকা বিভাগের মুসলিম কেন্দ্রের ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদপ্রার্থী ছিলেন কবি। ওই সময় কবি নজরুল তৎকালীন জমিদার মৌলভী আবু আল মোজাফফর আবদুল্লাহর (যার নামে কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর) বড় মেয়ের জামাতা, তৎকালীন ঢাকা ও সোনারগাঁয়ের জমিদার মৌলভী আবুল খয়রাত মোহাম্মদের বেচারাম দেউড়ির নূর বক্স লেনের সাহেব বাড়িতে অতিথি হিসাবে ওঠেন। এখানে তিনি তিন-চার মাসের মতো থাকেন। মৌলভী আবুল খয়রাত মোহাম্মদের বাবা মুন্সি নূর বক্সের নামেই নামকরণ করা হয় বর্তমান নূর বক্স লেনের। মুন্সি নূর বক্সের বাবা মুন্সি মোহাম্মদ আলম ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে সুদূর ইয়েমেন থেকে দিল্লিতে মোগল সম্রাট শাহজাহানের দরবারে আসেন। সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। মুন্সি মোহাম্মদ আলমের ছেলে মুন্সি নূর বক্স ইসলাম প্রচারের জন্য দিল্লি থেকে ১৬ শতকে ঢাকায় চলে আসেন এবং বর্তমানে নূর বক্স লেনের ৮/১ এর বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ঢাকায় মৌলভী আবুল খয়রাত মোহাম্মদের বাড়িতেই অতিথি হিসাবে ওঠেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল। মৌলভী আবুল খয়রাতের ছেলে মৌলভী আবু জাফর জিয়াউল হক ওরফে নাবালক মিয়া ছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডেলিস্ট। তিনিই কাশ্মীরি শাহ সাহেবের মাজার ভবন ও ঢাকার নিউমার্কেটের নকশা অঙ্কন করেন। জমিদার মৌলভী আবুল খয়রাতের বড় ছেলে মৌলভী আবুল হাসনাত ওই সময় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তার নির্বাচনি কাজে ঘোড়ার গাড়ি ও ৩০০ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। যদিও সেই নির্বাচনে কবি নজরুল পরাজিত হন।
কাশ্মীরি শাহ সাহেবের প্রকৃত নাম হজরত শাহ সৈয়দ মোহাম্মদ ইউসুফ আল কাদরী আল জিলানী। তিনি ছিলেন বড়পীর হজরত শাহ সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানীর (রহ.) সরাসরি বংশধর। কাশ্মীরি শাহ সাহেবের বাবা হজরত শাহ সৈয়দ মুহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ছিলেন ইয়েমেনের ক্রাউন প্রিন্স। কাশ্মীরি শাহ সাহেব তারই চাচাতো ভাই সুলতানুল আরেফিন হজরত শাহ সৈয়দ নুরুল হক কাদরী ওরফে আলা হুজুরের সঙ্গে বেচারাম দেউরির সাহেব বাড়িতে আসেন।
কাশ্মীরি শাহ সাহেবের বড় ছেলে হজরত শাহ সৈয়দ হোসাইন উর রহমান আল কাদরী আল জিলানী ও মেঝ ছেলে শাহ সৈয়দ আতাউর রহমান আল কাদরী আল জিলানী উভয়ের সঙ্গেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল আত্মার সম্পর্ক। তারা দুই সহোদরই ছিলেন সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী। কবির লেখা গজল তারা দুই ভাই নিয়মিত গাইতেন। কবি নজরুল কাশ্মীরি শাহ সাহেবের জীবদ্দশায় দ্বিতীয়বার বেচারাম দেউড়িতে আসেন ১৯৩৪ সালে। সেবারও তিনি আগের মতো কিছু সময় এখানে অতিবাহিত করেন। বর্তমান কাশ্মীরি শাহ সাহেবের মাজারের পাশেই শাহাজাদা সাহেবের বাড়িতেই ছিল কবি নিবাস। আর মাজারটি ছিল বাগানবাড়ির বাগিচার কেন্দ্রস্থলে। বাগিচায় প্রতিদিন ভোরবেলা অসংখ্য বুলবুলি পাখি এসে কিচিরমিচির করত। কবি বুলবুলির কিচিরমিচির সুরধ্বনিতে উদ্বেলিত হয়ে তখন রচনা করেন তার বিখ্যাত গজল ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই, ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’।
সরেজমিন দেখা যায়, বাগানবাড়ির বাগিচার পাশে কবির স্মৃতিবিজড়িত সেই বসতঘরটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রায়। বাগিচাটিও এখন আর নেই। সেখানে এখন নানা শ্রেণির মানুষের বসবাস ও দোকানপাট গড়ে উঠেছে। একটা অংশে রয়েছে কাশ্মীরি শাহ সাহেবের মাজার। কবির ব্যবহৃত পালঙ্কটি নূর বক্স লেনের জমিদার বাড়িতে সংরক্ষিত আছে। জমিদার আবুল খয়রাতের ষষ্ঠ বংশধর আবু মোহাম্মদ ইমরান সযত্নে কবির ব্যবহৃত পালঙ্ক, টেবিল, বুক সেলফ ইত্যাদি সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে তিনি বলেন, কবি নজরুল ইসলামের ব্যবহৃত এই পালঙ্ক ও আসবাবপত্র আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে শুধু কবি কাজী নজরুল ইসলামই নন, এই পালঙ্কে ঘুমিয়েছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীর মতো বিখ্যাত গুণীজন। এগুলো আমাদের ঐতিহাসিক উপাদান। তাই এগুলোকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আমরা পারিবারিকভাবেই নিয়েছি। আমি বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করব, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিময় স্থানটিকে ‘কাজী নজরুল স্কয়ার’ বা ‘কাজী নজরুল চত্বর’ হিসাবে নামকরণ করার জন্য।
এ বিষয়ে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী মুঠোফোনে যুগান্তরকে বলেন, শুধু বেচারাম দেউড়ি নয়, কবি কাজী নজরুল ইসলামের আরও অনেক স্মৃতি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে আমাদের জাতীয় কবির রয়ে যাওয়া অন্যান্য স্মৃতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ির কাশ্মীরি শাহ মাজারসংলগ্ন এই জমিদার বাড়িটি আমাদের জাতীয় কবির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং বহু অমর সৃষ্টির জন্মস্থান। একাধিকবার কবির আগমনের মাধ্যমে বেচারাম দেউড়ির বাগানবাড়িটি হয়ে উঠেছিল তার সৃজনশীলতার আধার। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃক জাতীয় কবির হারিয়ে যাওয়া এই স্মৃতি রক্ষা এখন সময়ের দাবি।
