ভুক্তভোগী নারীর লোমহর্ষক বর্ণনা
চলন্ত বাসে নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করে দুই ডাকাত
রাজশাহী ব্যুরো ও যুগান্তর প্রতিবেদন, টাঙ্গাইল
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ওই রাতে অন্তত একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সেই সঙ্গে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন বাসটিতে থাকা ছয় নারী যাত্রীর সবাই। রাজশাহীর এক নারী যাত্রীসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী ওই রাতে চলন্ত বাসে ডাকাতদলের হাতে নারী ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। ধর্ষণের শিকার নারীর বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুরে। তার কপালে সিঁদুর ছিল। তিনি একজন কীর্তন শিল্পী বলে বর্ণনাকারীর ধারণা। ধর্ষণের ঘটনার সময় বাসটিতে ওই নারীর স্বামী ও ভাই ছিলেন। বাসের ৬নং সিটে বসা ছিলেন তিনি। ডাকাতরা তাকে অস্ত্রের মুখে সিট থেকে তুলে টেনেহিঁচড়ে বাসের একেবারে পেছনের সিটে নিয়ে যায়। ডাকাতি চলাকালীন পুরো তিন ঘণ্টা তার ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। যদিও টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন ইউনিক রোড রয়েলস বাসে ডাকাতির সময় কোনো নারী ধর্ষিত হননি। তবে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন নারী যাত্রীরা। অনেকের স্পর্শকাতর স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ভুক্তভোগী নারী যাত্রীর লোমহর্ষক বর্ণনার পর নড়েচড়ে বসেছে টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ। বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কিনা সে বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করতে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে।
এদিকে রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠে বাড়ি এক ভুক্তভোগী নারী যাত্রী বলেন, আমার মেয়ে সাভারে চাকরি করে। আমরা সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি ও আমার মেয়ের শাশুড়ি রাত আনুমানিক ১২টার দিকে সাভারের হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে ইউনিক রোড রয়েলস বাসে উঠি। রাজশাহীর বাস মনে করে আমরা ওই রাতে বাসটির যাত্রী হয়েছিলাম। চালকের এক সারি পরের সারিতে ডানদিকে আমাদের সিট ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১১টার দিকে গাবতলী থেকে বাসটি রাজশাহীর উদ্দেশে ছাড়ে। বাসটি ছাড়ার সময় সামনের কয়েকটি আসন খালি থাকলেও ৭-৮ জন স্ট্যান্ডিং যাত্রী নেওয়া হয়। হেমায়েতপুরে আমাদের সঙ্গে আরও দুজন যাত্রীবেশী ডাকাত ওঠে। তারা যে ডাকাতদলেরই সদস্য এটা তখন আমরা কেউ অনুমান করতে পারিনি।
নারী যাত্রী আরও বলেন, ডাকাতরা অধিকাংশই যাত্রীবেশে বাসের সিটে বসা ছিল। বাসটি নবীনগর মোড় ক্রস করে বাইপাইল হয়ে জোরে চলতে শুরু করে। নন্দনপার্কের সামনে আসামাত্রই সিট থেকে উঠে তিন সশস্ত্র ডাকাত প্রথমে বাসের চালক বাবলু ইসলামের কাছে গিয়ে গলায় ছুরি ধরে চাবি নিয়ে নেন। একজন মধ্যবয়স্ক ডাকাত চালকের আসনে বসে বাসটি চালাতে শুরু করে। একই সময়ে বাসটির সুপারভাইজার মাহবুব আলম ও চালকের সহকারী সুমন ইসলামকে বাসের সিঁড়ির কাছে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ওই নারী যাত্রী আরও বলেন, গাড়িটিতে মোট নয়জন ডাকাত ছিল। তারা একে একে সিট থেকে উঠে এসে যাত্রীদের মারতে থাকে ও টাকা-পয়সা, গহনাগাটি, মোবাইল ফোনসহ যার কাছে যা ছিল সব লুট করতে থাকে।
একপর্যায়ে ডাকাতদের চোখ পড়ে ৬নং সিটে থাকা সিঁদুরপরা এক নারীর ওপর। তার কপালে তিলক ও গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ছিল। পোশাক-আশাক দেখে মনে হয়েছে ওই নারী কীর্তন দলের সঙ্গে কোথাও গান করতে গিয়েছিলেন। পাশেই তার ভাই বসা ছিলেন। আরেক সিটে ছিলেন তার স্বামী। ডাকাতদের দুজন অস্ত্রের মুখে ওই নারীকে টেনেহিঁচড়ে একেবারে পেছনের সিটে নিয়ে যায়। পেছনের সিটে বসে থাকা যাত্রীদের তুলে দিয়ে সেখানে সবার সামনে ধর্ষণ করে দুই ডাকাত। এ সময় মেয়েটি ভীষণ চিৎকার করছিল। ধর্ষক দুই ডাকাতের চেহারার বিবরণ দিয়ে নারী যাত্রী আরও বলেন, তাদের একজন ছিল নীল কোট পরা ও আরেকজন চেক শার্ট পরা। যাত্রীরা সবকিছু দেখলেও কারও কিছু করার ছিল না। বাসের ৬ জন নারী যাত্রীর প্রায় সবারই শ্লীলতাহানির শিকার হয়। তিনি আরও বলেন, আমারও গায়ে হাত দেওয়া হয়েছে। কেউ রক্ষা পায়নি ডাকাতদের কবল থেকে। ডাকাতরা শুধু ওই নারীকে ধর্ষণই করেনি, সারা শরীর মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত করে। ডাকাতরা নেমে যাওয়ার পর বাসটি থামলে ওই নারী বাস থেকে নামতে পারছিলেন না। তার মুখের দিকে তাকানোর মতো অবস্থা ছিল না।
ভয়াল ওই রাতের ঘটনার বিবরণ দিয়ে নারী যাত্রী আরও বলেন, ডাকাতি শুরুর কিছুক্ষণ পর ডাকাতরা বাসটিকে মির্জাপুরের দিকে চালাতে থাকে। হঠাৎ করেই বাসটিকে ঘুরিয়ে গাজীপুরের দিকে নিয়ে যায়। এক সময় আমরা লক্ষ করি বাসটি গাজীপুর সাফারি পার্ক হয়ে কোনাবাড়ীর দিকে চলছে। নারী যাত্রী আরও জানান, নাটোরের বড়াইগ্রামের দুজন লোক ছিলেন বাসের যাত্রী হিসাবে। তাদের একজন গুড়ের ও একজন মাছের ব্যবসা করেন। ডাকাতরা তাদের দুজনের কাছে থাকা তিন লাখ টাকা লুট করে। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী চলা ডাকাতির সময় প্রায় ৫০ জন যাত্রীর কারও কাছে কিছু রেখে যায়নি ডাকাতদল।
তিনি বলেন, ডাকাতরা বাসটি ঘুরিয়ে আবার নন্দনপার্কের কাছে একটা ফিলিং স্টেশনের কাছে থামিয়ে সবাই নেমে পড়ে। তখন গভীর রাত। আমাদের কারও কাছে এক ফোঁটা পানি কিনে খাওয়ার টাকাও নেই। সামনে সেনাবাহিনীর একটি টহল দেখে আমরা তাদের কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলি। তখন একজন সেনাসদস্য বলেন, আপনারা থানায় গিয়ে পুলিশকে বলেন। আমরা মাত্র তিনজন আছি। ডাকাতরা আমাদের ওপরও অ্যাটাক করতে পারে। এরপর আমরা মির্জাপুর থানায় গেলে ওসি আমাদের বলেন, আপনারা সকাল ৯টায় আসেন। এখন মামলা করা যাবে না। তখন বাসের চালক বাবলু ইসলাম বলেন, গাড়িতে তেল নেই। আমরা রাজশাহী যেতে পারব না। আমরা গাড়ি থেকে নামতে অস্বীকার করলে চালক ভোরের দিকে গাড়ি ছাড়েন রাজশাহীর উদ্দেশে। নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় পৌঁছলে পুলিশ চালক, সুপারভাইজার ও চালকের সহকারীকে হেফাজতে নেয়।
চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহা. শাজাহান বলেন, ঘটনাটিকে পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। টাঙ্গাইল এবং নাটোরের পুলিশ সুপার পুরো ঘটনা নিবিড়ভাবে তদারকি করছেন। আমি যতদূর জানি কোনো নারী ওই রাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেননি। এরপরও পুলিশ বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তদন্ত করছে।
এদিকে এ ঘটনায় গত শনিবার ভোরে সাভার থেকে তিন ডাকাতকে গ্রেফতার করে টাঙ্গাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের আদালতে পাঠালে সবুজ ও শরীফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এছাড়া মুহিদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
ইউনিক রোড রয়েল বাসের রুট পারমিট নেই : ডাকাত আক্রান্ত ইউনিক রোড রয়েলস বাসের রুট পারমিট না থাকলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী-নাটোর-ঢাকা রুটে এই ব্যানারে ৫টি বাস চলাচল করছে কয়েক বছর ধরে। যাত্রী প্রতারণার বহু অভিযোগ রয়েছে ইউনিক রোড রয়েলস বাসের মালিক, চালক ও সুপারভাইজারদের বিরুদ্ধে। ডাকাতের কবলে পড়া ময়মনসিংহ-ব-১১-০০৬৯ নম্বরের বাসটি ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে চলাচল করলেও এই রুটে চলাচলের রুট পারমিট নেই বলে জানা গেছে।
