কাউখালীতে বসতভিটায় ভাঙচুর-আগুন
আতঙ্কে মুখ খোলেন না রাঢ়িরহাটের মানুষ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অপহরণের হাত থেকে এলাকার ছেলেকে বাঁচানোই কাল হয়েছে কাউখালীর রাঢ়িরহাটের মানুষের। সেই ‘অপরাধে’ হামলা-ভাঙচুরের পর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিএনপি নেতা আব্দুল হাইর বাড়ি। মারধর করা হয়েছে বৃদ্ধ আব্দুল হাই ও তার স্ত্রী দেলোয়ারা বেগমকে। আওয়ামী লীগ ট্যাগ দিয়ে চালানো ওই হামলার পর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে দেওয়া হয়নি তাদের। উপরন্তু এলাকার মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে দফায় দফায় মানববন্ধন ও সমাবেশের নামে ছড়ানো হয়েছে আতঙ্ক। পরিস্থিতি এমন যে আবারও হামলা-ভাঙচুরের ভয়ে এখন আর মুখ খুলছেন না কেউ। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। হামলাকারীদের মামলা নিলেও বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ায় মামলা নেয়নি তারা। ঘটনার সূত্রপাত রোজার ঈদের ৩ দিন আগে ২৮ মার্চ রাতে। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার রাঢ়িরহাট বাজারে চা খাচ্ছিলেন ফলইবুনিয়া গ্রামের আব্দুল হাই রাঢ়ির ছেলে রহমতউল্লাহ রাঢ়ি (৪০)। হঠাৎ তিন চাকার ব্যাটারি যান আর মোটরসাইকেলে আসা ৮-১০ জন তাকে উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। চিৎকারে বাজারের লোকজন পিটুনি আর ধাওয়া দিলে অপহরণের চেষ্টাকারীরা পালিয়ে যায়। এ সময় আহত হয় ব্যাটারিযানের চালক বেল্লাল হাওলাদারসহ অপহরণ চেষ্টায় জড়িত ৫-৬ জন। ঘণ্টাখানেক পর অস্ত্রধারী শতাধিক ব্যক্তি হামলা চালায় রহমতের বাবা বিএনপি নেতা আব্দুল হাইর বাড়িতে। ভাঙচুরের পর জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাড়ি। আগুনের খবর পেয়ে কাউখালী থেকে ফায়ার সার্ভিস এলে আগুন নেভাতে বাধা দেওয়া হয় তাদের। রাঢ়ি বাড়ির বাসিন্দা গৃহবধূ শিউলি বেগম ও কলেজছাত্রী সাদিয়া আক্তার একই রকম তথ্য দিয়ে বলেন, হামলা-ভাঙচুরের ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিল যে, প্রাণ বাঁচাতেই পালিয়ে যাই সবাই। ২-৩ দিনেও আর ঘরে ফিরতে পারিনি। ঘটনার ১ মাস পরও তীব্র আতঙ্কে আছি।
বিএনপি নেতা আব্দুল হাই বলেন, বাড়িতে পুরোনো ঘরের সামনেই চলছিল নতুন ভবন তৈরির কাজ। ভবন নির্মাণের ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা আর জাকাতের কাপড়সহ প্রায় ৮-১০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। হামলাকারীরা সব নিয়ে গেছে। পুড়িয়ে দিয়েছে বসতবাড়ি। হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা নেয়নি কাউখালী থানা পুলিশ। উলটো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে হামলাকারীরা।
ঘটনার ১ মাস পর শিয়ালকাঠী গ্রামে গিয়ে মেলে অপহরণ আর হামলা-ভাঙচুরের নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য। যদিও এ ব্যাপারে নাম-পরিচয় উল্লেখ করে বক্তব্য দেওয়ার সাহস পাননি কেউ। পত্রিকায় পরিচয় ছাপা হবে না বলার পরই কথা বলতে রাজি হন রাঢ়িরহাটের মানুষ। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২৮ মার্চ রাতে ঘটা অপহরণ চেষ্টার নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সম্পাদক তারিকুল ইসলাম সুমন। সঙ্গে ছিলেন তার ভাই আওয়ামী লীগের মো. নাসিরউদ্দিন। তাদের বাড়ি শিয়ালকাঠি ইউনিয়নের শিয়ালকাঠি গ্রামে। ব্যবসায়ী রহমতউল্লাহ যুবলীগ কর্মী। তার ছোট ভাই রাসেল রাঢ়ি কাউখালী উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি। ৫ আগস্টের পর ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া নিয়ে বিরোধ বাধে দুপক্ষের। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে হামলা-মারধরের শিকারও হন রাসেল। সেই ঘটনার জের ধরেই মূলত অপহরণের চেষ্টা চালানো হয় রাসেলের ভাই রহমতকে। যা নিয়ে ঘটে হামলা-ভাঙচুর আর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। যদিও পরে ছড়ানো হয় পোস্টার লাগানোর সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলা মারধর এবং বিক্ষুব্ধ জনতার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার গল্প। এই গল্প সাজিয়ে প্রত্যন্ত শিয়ালকাঠিতে দুবার মানববন্ধন আর প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সুমন ও তার অনুসারীরা। এসব কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা হয় উপজেলা বিএনপির কয়েকজন নেতাকে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কাউখালী উপজেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, সুমনের বড় ভাই জসিমউদ্দিন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার অনুরোধেই সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছি। তাছাড়া জসিম যেহেতু কেন্দ্রীয় নেতা, তার সংগঠনের কর্মীদের দিয়ে সমাবেশ করানো তো কঠিন নয় তার জন্য।
এ বিষয়ে তারিকুল ইসলাম সুমন যুগান্তরকে বলেন, রাঢ়ি বাড়ির সবাই আওয়ামী লীগ করেন। রহমত খিলগাঁও যুবলীগের নেতা। ২৮ তারিখ রাতে বড় ভাই জসিমউদ্দিনের ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার লাগাতে গেলে রহমত-রাসেলরা হামলা করে। কুপিয়ে জখম করে বেশ কয়েকজনকে। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে সাধারণ জনগণ ওই ফ্যাসিস্টদের বাড়িতে হামলা চালায়। আমরা তাদের ঠেকানোর অনেক চেষ্টা করেও পারিনি। নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে স্থানীয় বিএনপি।
শিয়ালকাঠি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মনিরুজ্জামান মিন্টু বলেন, আব্দুল হাই রাঢ়ি এক সময় শিয়ালকাঠি ইউনিয়ন কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন। তার মেজো ছেলে রফিক রাঢ়ি এবং বড় ছেলে শহিদ রাঢ়ি বিএনপি করে। তবে অন্য দুই ছেলে রাসেল ও রহমত ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে জড়িত। ২৮ মার্চ রাতে ঠিক কী কারণে রাঢ়ি বাড়িতে হামলা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে সুমনরা বলছে যে পোস্টার লাগাতে গেলে নাকি তাদের ওপর হামলা হয়েছে।
কাউখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মু. সোলায়মান বলেন, এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে তারা কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি। অভিযোগ নিয়ে এলে অবশ্যই মামলা হিসাবে রেকর্ড করা হবে।

