Logo
Logo
×

শেষ পাতা

উপকূলের জীবন

নদী আর সাগরের ঢেউয়ে ভাসে রাঙ্গাবালীর স্বপ্ন

Icon

কামরুল হাসান, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী)

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নদী আর সাগরের ঢেউয়ে ভাসে রাঙ্গাবালীর স্বপ্ন

ছবি: যুগান্তর

পটুয়াখালী জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রাঙ্গাবালী। চারপাশে নদী আর সাগরের ঢেউ। মাঝে মানুষের টিকে থাকার গল্প। জোয়ার-ভাটার ছন্দেই চলে এখানকার জীবন। যেখানে প্রতিদিনই নতুন করে লড়তে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সঙ্গে। দেশের দক্ষিণপ্রান্তের এই জনপদে পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ নদীপথ। কিন্তু দিনের আলো ফুরোলেই থেমে যায় সব নৌযান। থেমে যায় বাইরের সঙ্গে যোগাযোগও। প্রায় দুই লাখ মানুষের এই দ্বীপে জীবনের চাকা ঘোরে কৃষি ও মাছ ধরে। নেই আধুনিক চিকিৎসাসেবা ও পর্যাপ্ত শিক্ষার আলো। তবুও এই দ্বীপের মানুষ থেমে থাকেন না; নৌকার দাঁড়ের মতো দৃঢ় হাতে চালিয়ে যান জীবনসংগ্রাম।

জানা যায়, ২০১২ সালে ‘উপজেলা’ হিসাবে স্বীকৃতি পায় রাঙ্গাবালী। এর কোল ঘেঁষে প্রবাহিত আগুনমুখা নদী। এটিকে বলা হয়-সাত নদীর মিলনস্থল। এই উত্তাল নদীই হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। ফেরি না থাকায় দেশের সঙ্গে রাঙ্গাবালীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। তাই যেখানেই যেতে হোক-স্পিডবোট, লঞ্চ কিংবা খেয়া নৌকাই ভরসা।

উপজেলা সদর ও ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়ন ছাড়া বাকি চারটি ইউনিয়নকেই (চালিতাবুনিয়া, চরমোন্তাজ, বড়বাইশদিয়া ও মৌডুবি) বিচ্ছিন্ন করেছে নদী। ফলে এই চার ইউনিয়নের একটি থেকে অন্যটিতে যেতেও পাড়ি দিতে হয় নদীপথ। দুর্যোগ মৌসুমে যোগাযোগব্যবস্থা হয়ে পড়ে ভয়াবহ। রোগী পরিবহণ, শিক্ষার্থী চলাচল, খাদ্য ও পণ্য পরিবহণ-সব কিছুই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

বাসিন্দারা জানান, চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছে এ জনপদের মানুষ। নেই উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও টেকসই বেড়িবাঁধ। এমনও চর আছে, যেখানে নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর নদী গিলে খাচ্ছে কৃষিজমি ও বসতভিটা। নদীভাঙনে অনেকে হারিয়েছেন প্রিয়জনের কবরও।

দুর্গম চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চরআন্ডা গ্রামের জামাল হাওলাদার বলেন, আমরা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছি। আমার নিজ গ্রাম চরআন্ডা থেকে রাঙ্গাবালী উপজেলা সদরে যেতেও তেঁতুলিয়া ও বুড়াগৌরাঙ্গ নদী পাড়ি দিতে হয়। আর উপজেলার বাইরে যেতে পার হতে হয় আগুনমুখা নদীও। দুর্যোগের সময় আমাদের ভোগান্তির কোনো সীমা থাকে না।

স্বাস্থ্যসেবা এখনো প্রকৃতিনির্ভর : এই দ্বীপে কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। নেই একজন এমবিবিএস ডাক্তার। এখনো গ্রাম্য ডাক্তার ও হেকিম কবিরাজের তাবিজ-কবজের ওপর ভরসা করে চলেন চরাঞ্চলের মানুষ। বাসিন্দারা জানান, উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে চারটিতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটিতে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, আরেকটিতে নেই। উপজেলার ১২টি ওয়ার্ডে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও কোথাও নেই একজন এমবিবিএস চিকিৎসক। নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও ওষুধ।

এখানে শুধু জ্বর, সর্দি, কাশিসহ সাধারণ অসুস্থতার চিকিৎসাই মেলে।

জানা যায়, উপজেলা প্রতিষ্ঠার এক যুগের বেশি হলেও সরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট রাঙ্গাবালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু ৫০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হওয়ার পর ২০২৪ সালের মাঝামাঝি কাজটি বন্ধ হয়ে যায়।

উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের মধু মিয়া বলেন, হাসপাতাল না থাকায় গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয় অভিভাবকদের। ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত নদী পার হওয়া যায় না। সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিতে না পারায় অনেক গর্ভবতী মায়ের মৃত্যুও ঘটছে।

ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপসহকারী মেডিকেল অফিসার ফিরোজ মাহমুদ বলেন, আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। জটিল-কঠিন রোগীদের গলাচিপা কিংবা পটুয়াখালী পাঠিয়ে দিই।

ভাঙনে দিশেহারা চালিতাবুনিয়া ও চরমোন্তাজের মানুষ : উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম ইউনিয়ন ‘চালিতাবুনিয়া’। আগুনমুখা, ডিগ্রি ও রাবনাবাদ নদী ঘেঁষে ইউনিয়নটির অবস্থান। সেখানে এমন কোনো পরিবার নেই যারা দুই-তিনবার নদীভাঙনের শিকার হয়নি। ভিটেমাটি হারিয়েছে অনেক পরিবার। কেউ হারিয়েছেন স্বজনের কবরও। ভাঙনের তীব্রতায় কেউ কেউ ত্যাগ করেছেন মাতৃভূমি। পাড়ি জমিয়েছেন নতুন কোনো জায়গায় কিংবা শহরে। মধ্য চালিতাবুনিয়া গ্রামের বৃদ্ধ রেণু বেগম আক্ষেপ করে বলেন, তিনবার ভিটামাটি হারিয়েছি। জায়গা-জমি যা ছিল, সবই নদী খেয়েছে। এখন যেখানে ঘর করেছি, সেটিও যে কোনো সময় বিলীন হতে পারে।

অন্যদিকে বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে আরেক দুর্গম ইউনিয়ন ‘চরমোন্তাজ’। এই ইউনিয়নের বউবাজার, মিটার বাজার ও নয়ারচর গ্রাম ভাঙনের কবলে।

যেখানে পৌঁছেনি শিক্ষার আলো : আধুনিক সভ্যতার এই যুগেও প্রত্যন্ত এমন চর আছে, যেখানে শিশুর কোলাহল আছে, কিন্তু নেই শিক্ষার আলো। তেমনই দুটি চর ‘চরকাশেম ও চরনজির’। উপজেলার সদর ইউনিয়নের আওতাধীন চরকাশেম ও ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের আওতাধীন চরনজির। এই দুই চরে আজও গড়ে ওঠেনি কোনো বিদ্যালয়। চরে তিন শতাধিক শিশু রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল কোনো কোনো পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের দূরের কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রেখে পড়ালেখা করান। কিন্তু অসচ্ছল পরিবারের শিশুদের কপালে এটি জোটে না।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দেবাশীষ ঘোষ বলেন, চরকাশেম ও চরনজিসহ যেসব এলাকায় স্কুল নেই, সেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিত্যদিনের সঙ্গী : মেঘের গর্জনেই আঁতকে ওঠেন চরাঞ্চলের মানুষ। জোয়ারের পানি বাড়লে আতঙ্কও বাড়ে। অস্বাভাবিক জোয়ারে নিচু এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। বেড়িবাঁধ নেই-এমন জায়গা প্লাবিত হয় বারবার। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরবাড়ি। দুর্যোগ মৌসুমে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষি ও মৎস্যনির্ভর পরিবারগুলো। পানি বাড়লে ভেসে যায় মাছের ঘের ও পুকুর। ফসল তলিয়ে যায়। চাষাবাদ হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। ফলে আয়রোজগার বন্ধ হয়ে বহু পরিবার চরম দারিদ্র্যে পড়ে।

এই উপজেলা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শাহিন আহমেদ বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এই উপকূলীয় দ্বীপগুলোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পিত, স্থায়ী ও টেকসই উদ্যোগ প্রয়োজন।

জীবিকার টানাপোড়েন : রাঙ্গাবালীর প্রধান দুই আয়ের খাত-কৃষি ও মৎস্য। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মানবসৃষ্ট সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের থাবায় এই দুটি খাতই এখন হুমকির মুখে। নদনদীতে আগের মতো মাছ নেই। সাগরেও এখন মিলছে না আর ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। ফসল উৎপাদন করতে গিয়েও রোগবালাই আর প্রকৃতির বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন কৃষক। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ও অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মাছের প্রজননক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে নদীতে প্রবাহ কমে যাওয়ায় মিঠাপানির মাছও কমে যাচ্ছে। নদীতে বেড়েছে ডুবোচর। এ কারণে মাছের চলাচলের গতিপথ বদলেছে।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, এই উপকূলে একসময় প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তরমুজ। ১০-১২ বছর আগেও রাঙ্গাবালীতে হাজার হাজার একর জমিতে তরমুজ হতো। কিন্তু এখন রোগবালাই ও বাজার সমস্যার কারণে তরমুজ চাষে আগ্রহ কমেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, একই জমিতে বারবার তরমুজ উৎপাদন এবং কোনো পরামর্শ ছাড়াই অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হওয়ায় অনেক জমিতে এখন তরমুজ ভালো হচ্ছে না।

উপজেলা পরিষদের প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব দাশ পুরকায়স্থ বলেন, এখানে ফেরিসেবা চালু হলে যাতায়াত সমস্যার সমাধাণ হবে। ফেরিসেবা চালুর জন্য আমরা একটি কাঁচা রাস্তা করেছি। সেটি পাকা করাসহ অবকাঠামোগত আরও কিছু কাজ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ফেরি বরাদ্দ করলেই এই উপজেলা সারা দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগে যুক্ত হবে। এছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাজ চালুর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। নদীভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে। চরাঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণেও শিক্ষা বিভাগ কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে রাঙ্গাবালীকে আলাদা পরিকল্পনার আওতায় আনা উচিত। জলবায়ু তহবিল বা দুর্যোগ সহনশীল অবকাঠামো এই অঞ্চলে অগ্রাধিকার পেলে পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম