Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বদরুদ্দীন উমর এশিয়ার লেনিন

Icon

আফজালুল বাসার

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বদরুদ্দীন উমর এশিয়ার লেনিন

বদরুদ্দীন উমর (২০.১২.১৯৩১-০৭.০৯.২০২৫) নিরাপোসপন্থি। তিনি নিরাপোস থেকেছেন পিতার রক্ষণশীল রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে। সাম্প্রদায়িকতাপন্থি মোনায়েম খানদের সঙ্গে যারা উদ্যোগ নিয়েছিল তার গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করার, তার মুক্তচিন্তা দলিত করার-তাদের সঙ্গে। ধর্মচর্চা বা ধর্মের বিরুদ্ধে নয় তিনি নিরাপোস থেকেছেন ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মযুক্ত রাজনৈতিক চিন্তা ও কাজের সঙ্গে। তিনি দেখিয়েছেন, সাম্প্রদায়িকতার শ্রেণিগত ভীত রয়েছে পুঁজিবাদ এবং সামন্তবাদের ওপর। নিরাপোস থেকেছেন পুরস্কার গ্রহণের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিচর্চার সঙ্গে। নিরাপোস থেকেছেন আপসপন্থি বিলোপবাদী রুশপন্থি’দের সঙ্গে। এমনকি নিরাপোসপন্থি চীনপন্থিদের সঙ্গেও, যেখানে রয়েছে পেটি বুর্জোয়া, অসর্বহারা, বিচ্ছিন্ন, সন্ত্রাসী এবং বালসুলভ বিপ্লববাদ। আপস করেননি আওয়ামী-বিএনপি-জামায়াত-কংগ্রেস-বিজেপির কর্তৃত্ববাদী-জঙ্গিবাদী-হিন্দুত্ববাদী চিন্তার সঙ্গে। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির উগ্রতাকেও ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে থেকে (সিপিএম-সিপিআই-সিপিবি) রাজনীতি করা এবং অন্ধ অনুকরণবাদী, অবাস্তব ও স্থানীয় পরিস্থিতিতে অকার্যকর পদ্ধতি (চারু মজুমদার) অনুসরণ করার ভ্রান্তি প্রদর্শন করেছেন।

তিনি দেখিয়েছেন, রুশ বিপ্লবের ভিত্তি ছিল মূলত শ্রমিক আন্দোলনের ওপর। অন্যদিকে চীন বিপ্লবের ভিত্তি ছিল কৃষক আন্দোলনের ওপর। এ উভয় বিপ্লবের নেতৃত্ব ছিল মধ্যবিত্তের হাতে যাদের আদৌ মধ্যবিত্ত বৈশিষ্ট্য ছিল না, ছিল সর্বহারা বৈশিষ্ট্য। এদিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেছে মধ্যবিত্ত, তাদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে মধ্যবিত্ত, যাদের বৈশিষ্ট্যও ছিল মধ্যবিত্তের। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন থেকে আগতরা শেষতক বিচ্ছিন্নতা এবং সন্ত্রাস ধারণ করেছেন। পার্টি শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন, কিষান সভা, প্রগতি লেখক সংঘ এবং গণনাট্য সংঘ গঠন করে গণভিত্তি অর্জন এবং রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা অর্জন করলেও থেকে গিয়েছেন মধ্যবিত্তপন্থি, কংগ্রেস কাঠামোর মধ্যে আন্দোলন করেছেন তার বাইরে আসেননি। তাদের তেভাগা ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনে সংগঠনগত এবং রূপগত বিপ্লবী উপাদান থাকলেও তা অর্থনীতিবাদী হওয়ায় এবং ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক রণনীতি-রণকৌশল-বিযুক্ত হওয়ার কারণে চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যেতে পারেননি। যে আজাদীর জন্য এবং যে আজাদী কংগ্রেসের কাছে হস্তান্তরের জন্য তারা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সংগ্রাম করেছেন সে আজাদীকে ঝুটা অভিহিত করে তারা তার বিরোধিতা শুরু করেন এবং ওদিকে নেহেরুরা এদিকে নাজিমুদ্দীনরা কমিউনিস্ট পার্টি বরদাশত করেননি। এ অবস্থায় তারা জেলের মধ্যে আন্দোলন শুরু করেন। পরে তারা আংশিক বা পূর্ণভাবে ক্ষমতায় এসেও নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে ভূমি সংস্কার বা সমবায় গঠন করতে পারেননি। চারু মজুমদাররা শ্রমিক শ্রেণিকে যেমন অবহেলা করেছেন, তেমনি জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সংসদীয় এবং ‘সন্ত্রাসবাদী’ ধারার বাইরে আসতে পারেনি। অন্যদিকে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। এ পরিস্থিতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে উমর ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলোকে ‘ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণির বাম অংশ’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।

উমরের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সত্তরের দশকে বা তার আগে বাংলাদেশে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির অবস্থান ছিল। এ আধা সামন্তবাদী আধা উপনিবেশিক ব্যবস্থায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদনের প্রশ্নে দেখা যায়, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদপন্থিরা ছাড়া অন্য সব কমিউনিস্ট দল মনে করেন, এদেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদিত হয়নি। এ আপসপন্থিরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এখানে অধনবাদী বিকাশ হচ্ছে এবং সমাজতন্ত্র গঠিত হচ্ছে। তাদের স্লোগান হলো : এবারের সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম। (বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা) ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কেননা তারা জানত তারা পাবে ভাত-কাপড়-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থল, পাবে জীবনে বাঁচার নিরাপত্তা। কিন্তু তারা তা পাননি বরং তারা ‘চরম নির্যাতনমূলক শাসন-কাঠামোর মধ্যে বন্দি হয়ে তাদের জীবনে দুর্দশার শেষ নেই।’

মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন ও নির্যাতনের প্রতিরোধে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল। শুরুতে যে প্রগতিশীলতা ছিল তা ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে দ্বিধাবিভক্ত হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অবাঙালিরা পূর্ব বাংলার অর্থনীতি শিল্প বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। সেখানে আওয়ামী লীগের কোনো অবস্থান ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে ‘অনিয়ন্ত্রিত লুটপাট’ ও নৈরাজ্য শুরু হয়। তারা ‘শোষণের মাধ্যমে উৎপাদনের একটা অংশকে আত্মসাৎ করে।’ বাংলাদেশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষণা করে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ অবাঙালি এবং বাঙালি প্রধান অংশ জাতীয়করণ করা হয়, যা ছিল ‘লুটপাটেরই অংশ’। এ লুটপাটকারীদের মজুতদারি এবং মুনাফাখোর থেকেই মূলত ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যেখানে প্রায় ৪ লাখ মানুষ মারা যায়। কাজেই এদের সমাজতন্ত্র ছিল ‘একটি ভুয়া ব্যাপার’। একদলীয় সরকার গঠন করেও তারা চরম নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতির জাতীয়তাবাদ ছিল খণ্ডিত, বাংলাদেশি এবং ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতাকে আড়াল করার ঢাল। এ ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তার অন্তর্নিহিত ঐক্যটি হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, যার ভীত রয়েছে পুঁজিবাদ এবং সামন্তবাদের ওপর।

যদিও একথা বলতেই হবে, ষাটের দশকে উমরের ব্যাপক বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান ছিল; কিন্তু পরবর্তী দশকগুলোতেই তিনি তার রাজনৈতিক চিন্তার অনুশীলন এবং বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং সেখানে তার অবদান ব্যাপকতর। সেখানেই তিনি তার ইতিহাসচিন্তা ও রাজনৈতিক চিন্তাসহ জনগণের রাজনীতির জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তাগুলো সূত্রায়িত করেছেন। তিনি দেখান, বর্তমানে আমাদের দেশ প্রাক-ধনবাদী এবং ঔপনিবেশিক স্তরে আছে। এ অবস্থায় দেশে গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন গণ-অভ্যুত্থান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকে আইউববিরোধী একাধিক আন্দোলন এবং ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাফল্য এসেছিল, যার রূপ ছিল অভ্যুত্থানমূলক। একাত্তরের মার্চেও গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল। এসব গণ-অভ্যুত্থানে বিশেষ দাবি আদায় হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন বা উচ্ছেদ হয় না। সে কাজ করতে হলে প্রয়োজন সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল বা কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ও নেতৃত্ব। কমিউনিস্ট পার্টিকে কৃষক শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের সংগঠন গড়ে তুলে সর্বস্তরের জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, গণ-অভ্যুত্থানের জন্য থাকতে হবে চতুর্বিধ শর্ত ক. শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরীণ সংকট, খ. তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারানো, গ. জনগণের বিশাল সক্রিয় সমাবেশ এবং ঘ. সমগ্র জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক দল, সে দলের সক্রিয়তা ও নেতৃত্ব। যে দলের শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলই নয়, তাকে টিকিয়ে রাখা ও আরও অগ্রসর করে নেওয়ার মতো যথেষ্ট নীতিমালা ও কর্মকৌশল প্রণয়নে সক্ষমতা রয়েছে। এটা দেখা গেল ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে কী আছে, আর কী নেই।

ক্ষীণবাদীরা অভিযোগ করেন, ‘উমর একজন বুদ্ধিজীবী’। উত্তর, তিনি যদি বুদ্ধিজীবী হন, তাতে কোনো সমস্যা নেই, প্রকৃতপক্ষে তিনি বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী হওয়া খুবই প্রয়োজন, তা না হলে কমিউনিস্ট হওয়া যায় না। মার্কস-এঙ্গেলসরাও বুদ্ধিজীবী ছিলেন, মধ্যবিত্ত ছিলেন। এ অভিযোগকারীরা কী? তারা কি বুদ্ধিজীবী? উমরের রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত বহু বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান। ক্ষীণবাদে বলা হয় ‘উমর মধ্যবিত্ত নিয়ে কাজ করেছেন’। তাদের প্রকৃত অভিযোগ টিকবে না, কারণ মধ্যবিত্তকে বিপ্লবী হয়ে উঠার প্রয়োজন আছে। রুশ এবং চীন বিপ্লবে নেতৃত্ব ছিল মধ্যবিত্তের হাতে, কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বহারার। কাজেই উমর মধ্যবিত্ত নিয়ে কিছু কাজ করেছেন, সেটা খুবই প্রয়োজন। এ ক্ষীণবাদের নজর যদি পড়ত উমরের জীবনের শেষ ষাট বছর এবং অদ্যাবধি উমরের কাজের দিকে, তাতে দেখা যেত তিনি কাজ করেছেন এদেশের কৃষক-শ্রমিক নিয়ে, লিখেছেন তাদের নিয়ে, থেকেছেন তাদের সঙ্গে, নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের পার্টিতে। ক্ষীণবাদীরা বলেন, ‘তিনি অভিবাসিত’?। কিন্তু ৪৭-এর দেশভাগ এবং ৭১-এর পাকিস্তান ভাগ কি এদেশের কোনো মানুষকে মজলুম মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার রাখে? চে আর্জেন্টিনার অধিবাসী হয়েও কিউবা বিপ্লবের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। ক্ষীণবাদীরা বলেন, ‘উমর বিপ্লব সম্পাদন করতে পারননি’। একথা সত্য; কিন্তু চেষ্টা করেছেন এবং তার চেষ্টাটা মোটেও সাধারণ ছিল না। বাংলাদেশে শুধু নয়, গোটা ভারতবর্ষেই তার তুল্য সংগ্রামী-বিপ্লবী খুঁজে পাওয়া কঠিন। অনেক গ্রন্থরচনা শুধু নয়, অনেক পত্রপত্রিকা সম্পাদনা, অনেক সম্মেলন, অনেক সেমিনার সংগঠিত করেছেন, যোগ দিয়েছেন তাতে এবং অনেক আন্দোলন সংগঠিত করেছেন তিনি, নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনেক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পার্টি গঠন এবং তারা দ্বারা বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেছেন। তার কাজ আগামীদিনের বৈপ্লবিক সংগ্রামকে পথ দেখাবে।

মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও এরপর শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে তার মতো মার্কসীয় বিশ্লেষক খুঁজে মেলে না-কিউবা-ভিয়েতনাম-তিরানা-কোরিয়া কোথাও না। সমাজতন্ত্রের অনিবার্য ভবিষ্যৎ গ্রন্থ এবং বাংলাদেশ-ভারত তথা সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে এবং সাম্রাজ্যবাদী-ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণ নিয়ে তার অনেক গ্রন্থে এবং আরও অনেক গ্রন্থে যার সংখ্যা শতাধিক-তিনি আজীবন সাধনায় মার্কসীয় চর্চার যেসব এলাকা স্পর্শ করেছেন, তা সারা বিশ্বকে বহু বছর ধরে গণতান্ত্রিক চিত্তসম্পদ জোগান দেবে। তাই সুকান্তকে বরাত দিয়ে আমার মন যে বিষয়টা বলার জন্য ব্যগ্র, তা হলো-‘বিপ্লব স্পন্দিত বক্ষে মনে হয় উমর এশিয়ার লেনিন’।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম