Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আমার কবি হেলাল হাফিজ

Icon

ধ্রুব এষ

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হেলাল হাফিজ : ১৯৮৬

চোখের সাদা অংশে জবা ফুলের রং ধরিয়ে রাখেন।

এই কবি খুব রাগী।

বইমেলায় দেখি, কথা বলি না। দ্বিধায় বলি না।

খালিদ আহসান প্রচ্ছদ করেছেন, কবির একটা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে বইমেলায়।

যে জলে আগুন জ্বলে।

কিনেছি। অটোগ্রাফ নিইনি। জবা ফুলের রং ডরাই।

হেলাল হাফিজ : ১৯৮৮

রঙিন হৈ হল্লার দিন সেসব।

উড়ে কেটে যায়, পুড়ে কেটে যায়।

ধোয়ামগ্ন এক উদ্যানের দুপুর। ক্ষুধা লেগে গেছে, পকেটে টাকা নাই।

একজনের পকেটেও নাই।

ইয়াসিন বলল, ‘চল, প্রেসক্লাবে যাই।’

মাসুম বলল, ‘লও যাই।’

প্রেসক্লাবে কী? ভাত মিলবে?

রোদের উদ্যান থেকে প্রেসক্লাব, হাঁটা দূরত্ব তখন। না হলেও হাঁটতেই হতো। এ ছাড়া ঋষি ঔতরেয় ‘চরৈবেতি’ বলেছেন। আগে বাড়ো। সেটা চক্রযানে নাকি হেঁটে?

পায়ের তলার পথ ফুরালো লহমায়।

প্রেসক্লাবের রিসেপশন। ইয়াসিন বলল, ‘আমরা হেলাল ভাইয়ের কাছে আসছি।’

‘উনি তো খাইতেছেন।’

‘আমরাও খাব।’

‘জি?’

‘না, বললাম অসুবিধা নাই। উনারে খবর দেন, মোক্তারপাড়ার ইয়াসিন আসছে।’

স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, রিসেপশন পার হতেই দেখা গেল কবিকে। খুবই মনোযোগসহকারে খাচ্ছেন। অন্যমনস্কভাবে তাকালেন। নেতাদের মতো হাত তুলল ইয়াসিন। কবিকে আশ্বস্ত করল ‘আমরা আসছি’? কবি কি আশ্বস্ত হলেন? তবে দেখলেন। ইয়াসিন তার প্রেমিকার পাড়ার, আবার কবিও। কবির সিগন্যাল বুঝল। বলল, ‘আয়, বসি।’

পরম যত্নের সঙ্গে কবি খাচ্ছেন।

বাংলা সাহিত্যের কোনো বড় কবিকে এই প্রথম আমি ভাত খেতে দেখলাম। বড় কবিরা ভাত খান না তা নয়, দৃশ্যগত দিকটার কথা বলছি। ফ্লাশব্যাকে যেতে হয় না, এখনও সেই দৃশ্য দেখতে পাই।

অন্নগ্রহণ করে কবি উঠলেন।

নিকটবর্তী হলেন ক্ষুধার্ত তারুণ্যের।

ইয়াসিন ত্রেকোনার মোক্তারপাড়ার। মাসুমও নেত্রকোনার। সাতপাইয়ের। আমি বললাম, ‘আমি উকিলপাড়ার।’

নেত্রকোনায় একটা উকিলপাড়া আছে। আমাদের সুনামগঞ্জেও একটা উকিলপাড়া আছে। দেশে আরও অনেক উকিলপাড়া আছে। থাকুক। আমরা ক্ষাধার্ত।

ইয়াসিন বলল, ‘দুপুরে আমরা কিছু খাই নাই।’

কবি বললেন, ‘কী খাবি তোরা?’

ইয়াসিন বলল, ‘ভাত।’

‘ভাত তো এখন এইখানে পাবি না। ক্যান্টিনে আগে বলে রাখতে হয়। পুরি খাবি? পুরি দিতে বলি?’

‘খাব।’

কবি বারটা পুরি দিতে বললেন। আলুপুরি না ডালপুরি মনে নাই।

বারটা পুরি রেখে গেল এবং পাতে না পড়তে উধাও। ক্ষুধার্ত তারুণ্য। কবি আরও বারটা দিতে বললেন। আরও বারটা। এরপর চা। ওম শান্তি! কবির সঙ্গে দুনিয়ার কথা হয়ে গেল এক বেলাতেই।

কবি কবির মতো। কবি স্নেহশীল। ছায়ার গাছ এক। আমরা নিশ্চিত করে জেনে গেলাম আমাদের বাকি জীবনের জন্য। আমাদের, আমার হেলাল ভাই আছেন। কবি হেলাল হাফিজ। অবশ্যপাঠ্য ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবি।

চোখের লাল রং শুধু রাগের না, দুনিয়ার মায়ারও।

আমরা তিনজন পা স্পর্শ করে সালাম করলাম হেলাল ভাইকে, প্রেসক্লাব ছাড়ালাম এবং মিশে গেলাম নগরীর উজ্জ্বল-অন্ধকার সন্ধ্যায়।

বহুদিন আর যাইনি আমাদের এক দুপুরের অন্ন(?)-দাতা সকাশে। এতদিন পর কী মনে হয়?

ইয়াসিনের কী মনে হয় জানি না। ‘পোশাক বাউলের অন্তর গরুর দালালের’- কব্যগ্রন্থের কবি ইয়াসিনুর রহমান। অসুস্থ সে। নেত্রকোনায় আছে। মাসুম ঢাকায়। মাসুম পারভেজ। আমাদের দেখা হয়। হেলাল ভাইকে নিয়ে কথা হয়। আমরা বার বার সেই দুপুরে ফিরে যাই।

আহ! হেলাল ভাইকে আমার আশ্চর্য বিষণ্ন সুন্দর এক পাথর মনে হয়। নদী ছিল, পাথর হয়ে গেছে। সেই পাথর। নদী তার ভেতরে বহমান। আত্রেয়ীর মতো অন্তঃসলিলা

হেলাল হাফিজ : ১৯৯৩-৯৪

অদ্ভুত আঁধার এক। মাতৃগর্ভের যে অন্ধকার। আমার এক দার্শনিক বন্ধু বলেন, এই অন্ধকারেই ঠিকঠাক হয়ে যায় সব। এ কবি হবে, এ খুনি। কবিজন্ম সব সময়ই ঈর্ষাযোগ্য। চিরকালীন একটা কথা বলে চলে গেছেন এক মিলু দাশ, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ কবিজন্ম তবে আলাদা।

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

কোথায় পড়েছেন?

বইয়ের পাতায় নাকি দেয়ালে?

গ্রাফিতি আর চিকা মারা কি এক? এক না হলেও এক গোত্রের। গ্রাফিক অ্যাজিটেশন। বাংলা আর কোনো কবিতার লাইন নিয়ে মনে হয় এতবার গ্রাফিক অ্যাজিটেশন হয়নি। আমাদের আগের মানুষজন দেখেছেন, আমরা আশি-নব্বই-এর দশকে দেখেছি দেয়ালে দেয়ালে, এখন যৌবন যার... ফুটে আছে শিমুল ফুল লাল রঙের অক্ষর। সে গত শতাব্দীর ঘটনা। গ্রেগরিয়ান শতাব্দী। সত্তর, আশি এবং নব্বই, তুমুল তিন দশক ছিল কবিতার। হেলাল ভাই তখনই কিংবদন্তি। আড্ডার, কানাঘুষার, ফিসফাঁসের মানুষ হয়ে গেছেন। আগন্তুকের মতো রহস্যময় কেউ আমাদের দেশের কোন কোনায় না উড়ে গেছে সেইসব শব্দাবলি।

নিউট্রন বোমা বোঝো,

মানুষ বোঝো না

কষ্ট নেবে কষ্ট...

আমিও গেরামের পোলা...

কবিতা এবং জনপ্রিয়। সরল সিধা হিসাব বিবেচনা। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কত কপি বিক্রি হয়েছে? সঠিক হিসাব আছে? বিক্রি হয়েছে এবং হচ্ছে। এত বছর ধরে একদম নতুন আর কোনো বই প্রকাশিত হয়নি হেলাল হাফিজের। তাতে কী? ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ তরুণরা পড়ে এখনও। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইয়ের যে কোনো কবিতা।

‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘অনিন্দ্য’ প্রকাশনা থেকে। পরে ‘দিব্যপ্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং বর্তমানে দ্বাত্রিংশ মুদ্রণ চলছে। ‘দিব্য’-র দুটো মুদ্রণের প্রচ্ছদ আমি করেছি। দ্বিভাষিক সংস্করণেরও। যুবক অনার্য ইংলিশ অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ ভালো হয়েছে কিনা বলার মতো ইংলিশ বিদ্যা আমার নাই। দেবাশিসদা বলেছেন ভালো হয়েছে। দেবাশিসদা ইংলিশের জাহাজ। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ নিশ্চয় আরও নানা ভাষায় অনূদিত হবে।

ধান ভানতে শিবের গীত বলে আর কাকে? এই শীতের রাতে জলে পড়েছি, যে জলে আগুন জ্বলে। না হলে আমার লেখার কথা শুধু হেলাল হাফিজের বইয়ের প্রচ্ছদগুলো নিয়ে, যে প্রচ্ছদগুলো আমি করেছি।

হেলাল হাফিজের বইয়ের সংখ্যা?

দুই যোগ দুই চারটা। দুটো দ্বিভাষিক। চারটা বইয়ের প্রচ্ছদই আমি করেছি। সেসব প্রচ্ছদ নিয়ে কী লিখব, প্রচ্ছদেই লেখা না হয়ে থাকে যদি। গতবছর এক জাতকবি আমার বানানো তার একটা বইয়ের প্রচ্ছদ এই বিবেচনায় বাতিল করেছেন যে, তার কবিতা আমি বুঝতে পারি নাই। ন্যায্য কথা। সব কবিতা আমি কী করে বুঝব? সেটা দুরূহ। তবে হেলাল হাফিজের কবিতা মনে হয় নিজের মতো করে বুঝি কিছুটা। আশ্চর্য বিষণ্ন সুন্দর পাথরের নীল, সোনালি, লাল, ধূসর রং বুঝি।

হেলাল হাফিজ : ১৯৯৬-৯৭

‘অচল প্রেমের পদ্য’। হেলাল হাফিজ।

কবিতার কার্ড। বারটা কবিতার প্যাকেট।

খালিদ আহসান অলংকৃত।

এমন জিনিস আগে দেখি নাই। অভিনব

‘অচল প্রেমের পদ্য’ প্রথমে কত প্যাকেট ছাপা হয়েছিল?

এত সচল প্রেমের পদ্য আর হয়েছে? প্রকাশকাল আমার মনে নাই। ১৯৯৬-৯৭-এর কোনো একদিন কথা হল মাধবদার সঙ্গে। ত্রয়ী প্রকাশনের মাধব চন্দ্র দাস। ‘অচল প্রেমের পদ্য’ প্যাকেটটা মাধবদা আবার ছাপবেন। আমি কি অলংকরণ করব? অবশ্যই।

মাধবদা তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে কবি হেলাল হাফিজ সম্পর্কে বললেন। অত্যন্ত খুঁতখুঁতে মানুষ। অলংকরণ থেকে টাইপ সেটিং পর্যন্ত সব তাকে দেখাতে হবে। ঠিক আছে। দেখাব। মাধবদাকে আর কিছু বললাম না। শংকা ছিল, এতদিন পর, আমাকে মনে রাখার কথা কি হেলাল ভাইয়ের?

কেমন মনে রাখবেন?

বইয়ের গ্রাফিক্সে তখনও কম্পিউটার ঢোকেনি। কী-ড্রয়িং করে বইয়ের প্রচ্ছদ এবং রঙিন অলংকরণ করতে হতো। বারটা কার্ড ড্রয়িং করলাম, কী-ড্রয়িং করলাম, কালার চার্ট করলাম। টাইপ কম্পোজ হল ফটো কম্পোজে। মাধবদার সঙ্গে গেলাম কবিকে দেখাতে। কবি প্রথম আমাকে দেখলেন, ‘আরে! তুই!’

হ্যাঁ আমি। আপনার আমি।

‘অচল প্রেমের পদ্য’ ছাপা হল আবার। আমার প্রচ্ছদ এবং অলংকরণে। নিশ্চিত তবে। আমার জন্য স্নেহমায়ার এক অন্তঃসলিলা নদী কিংবা চিরহরিৎ গাছ, সবসময় আছে এই নগরে।

হেলাল হাফিজ : ২০০০-২০২০

তার মা কোকিলা খাতুন। বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার। কবি। কবির পুত্র কবি হয়েছেন। তার সব কবিতা কি আমি পড়েছি? পড়েছি। একাধিকবার। মুদ্রিত যত কবিতা। যদিও আমি কবিতার তেমন ভালো পাঠক না কখনই। ছন্দ বুঝি না, মাত্রা বুঝি না। ‘পথের পাঁচালি’ দেখতে হলে কি আর সিনেমা বানানোর কৌশল জানতে হয় দর্শককে? সাধারণ দর্শকের একরকম দেখা আছে। তেমন একরকম পড়া আছে সাধারণ পাঠকেরও। বোঝাপড়া আছে।

আমি খুব সাধারণ একজন পাঠক। বুঝে না বুঝে কবিতা পড়ি। হেলাল হাফিজের কবিতা পড়ি বারবার।

গত বছর, আগস্ট-সেপ্টেম্বরের ঘটনা। হেলাল ভাই খুব অসুস্থ শুনলাম। তাকে দেখতে গেলাম আর কোথায়, প্রেসক্লাবে, আর কোথায়? সঙ্গী কবি মোস্তফা ইকবাল। মর্মে বিঁধল পাথরের কিছু অভিমান কিংবা এক শামুক, গুটিয়ে থাকা।

কিছুদিন পর ‘দিব্যপ্রকাশ’ থেকে একটা বইয়ের প্রচ্ছদ করতে বলা হল আমাকে। ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইয়ের প্রচ্ছদ। হেলাল ভাইয়ের নতুন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। কতদিন পর!

প্রচ্ছদ বানালাম। একটা না, তিনটা। এক্রিলিকে পেইন্টিং। হেলাল ভাই পছন্দ করলেন। কিন্তু কাজ এখানেই শেষ না, বইতে কবিতা থাকবে পঁয়ত্রিশটা। অলংকরণ যাবে কবিতার সঙ্গে।

‘অক্টোবরের মধ্যে করে দিবি তুই।’

অবশ্যই। পাণ্ডুলিপির গ্রুফ কপি দিয়ে গেল সোহরাব। ছোট ছোট পঁয়ত্রিশটা কবিতা। একবার পড়লাম। দীর্ঘতম কবিতা ১৮ লাইন। হ্রস্বতম কবিতা ১ লাইন, ৫ শব্দ। আরও আট-নয়-দশবার পড়লাম এবং ভুলে গেলাম। এটা হিরণদার কাছ থেকে শিখেছি। হিরণ মিত্র।- কবিতা পড়ো এবং ভুলে যাও। না হলে তুমি আঁকবেটা কী?- বিশদ করি একটু। কবিতা কী? শব্দের নেকলেস। শব্দ, অক্ষরের নেকলেস। অক্ষর? ছবি। শেষ পর্যন্ত কবিতা তো অক্ষর দিয়ে বানানো ছবিই। ছবির পাশে ছবি। দুই ছবি এক কথায় বললে কি হবে? অতএব, সব ভুলে গিয়ে আমি পঁয়ত্রিশটা কবিতা আঁকলাম। কী হল না হল এখন হেলাল ভাই বলবেন।

বই প্রকাশিত হল অক্টোবরেই। সোহরাব ‘সৌজন্য’ এক কপি বই নিয়ে এলো।

‘হেলাল ভাই আপনার সঙ্গে কথা বলবেন, দাদা।’

বলে সোহরাব কল দিল এবং ধরিয়ে দিল হেলাল ভাইকে।

‘হেলাল ভাই?’

‘কে? ধ্রুব?’

‘হ্যাঁ, হেলাল ভাই।’

‘তুই আয় তোর ঠ্যাঙ ভেঙে দেব।’

‘ই-!’

‘তুই এইসব কী করছিস বল তো? এইসব কি কবিতার অলংকরণ হল?

আমি তো ভাবতেই পারি নাই...।’

আমি... আমার কী হল, লেথোলজিকা?

‘বাকরুদ্ধ’ শব্দটাই মনে পড়ল না।

‘আরে না রে শোন। তোর সমস্ত অলংকরণই আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুই আয়, এখনই আয়।’

পাথরের, নদীর বা গাছের উচ্ছ্বাস। আমি সামান্য, আর কত চাই!

আজ বুধবার। ৮ জানুয়ারি। ২০২০।

যুবক অনার্য হেলাল ভাইয়ের আরও কিছু কবিতা ইংলিশে অনুবাদ করেছেন। বই হয়েছে। বইয়ের নতুন সংস্করণ হবে। যুবক অনার্য এবং প্রকাশক এসেছিলেন গত সপ্তাহে। হেলাল ভাই বলেছেন, নতুন সংস্করণের বইটার প্রচ্ছদ আমাকে করে দিতে হবে। কী ড্রয়িং, রঙের আন্দাজ, এসব বালাই এখন নাই আর। উন্নততর প্রযুক্তি মুদ্রণ কাজ সহজতর করে দিয়েছে। কম্পিউটারে যা দেখা যায়, ধরে নেয়া যায় সেটাই ‘প্রিন্টেড’ প্রচ্ছদ। ডিজাইন বানিয়ে কালার প্রিন্ট করে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম হেলাল ভাইকে। গতকাল দুপুরে। আবার মায়া, স্নেহের উষ্ণতা।।

কবি হেলাল হাফিজের ৪ না, ৫টা, সব বইয়ের প্রচ্ছদ তাহলে আমি করেছি।

আমার লেখা শেষ এখানেই। না, কূটনামি করি একটু। হেলাল ভাই কবি। হেলাল ভাই প্রেমিক। নেত্রকোনার হেলেন সেই কবে আমাদের কাছে ট্রয়ের হেলেন হয়ে গেছেন। হেলাল ভাই প্যারিস হলেন না। কেন হবেন? অবিমৃষ্যকারী বোকা প্যারিস। নাসরিন আপা, তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে কি হেলাল ভাইয়ের প্রেম ছিল নাকি? আমি একদিন তাদেরকে একসঙ্গে দেখেছিলাম রিকশায়। আর একটা সন্দেহজনক কবিতা ‘অচল প্রেমের পদ্য’ প্যাকেটে ছিল, আছে ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইতেও। তিন লাইনের বলে উঠিয়ে দিচ্ছি,

ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’,

মন না দিলে

ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা।

‘তনা’ কে?

তসলিমা নাসরিন?

আচ্ছা, এরা কারা? জুলেখা, শিরি, সাবিত্রী, রজকিনীর আড়ালে আবডালে? হেলাল ভাই এবং তার প্রেমিকাদের নিয়ে দারুণ একটা ফিকশন লেখা যায়। নিশ্চয় কেউ লিখবেন কখনও। তার সঙ্গে দেখা হবে শিরি, সাবিত্রীর। এবং দেখা হবে ভাবনাদের। এক ভাবনার কথা বলি। হেলাল ভাইয়ের প্রেমিকা। কবি বলেছেন, ‘আই লাভ হার।’ আমাকে বলেছেন। চিরকাল যৌবন যার... কবিকে ভাবনা জনসমক্ষে চুম্বনের অধিকার দিয়েছেন। কবি যখন তার ভাবনাকে চুমু খান, আমাদের ভাবনা করতে দোষ নাই, কবি তখন গাছ, নদী, পাথর। কবি তখন পক্ষীমাতা এক।

আর কূটনামি না করি। একজনের কথা বলি। হেলাল ভাইয়ের কবিতায় ইনি আছেন। মুহূর্তে আছেন। এখনও। চেতনে-অবচেতনে। মাতৃগর্ভের অন্ধকারেই হয়তো ঠিক হয়ে গিয়েছিল কবি হবেন কোকিলা খাতুনের ছেলে। মা অকালে চলে গেলেন, সেই ছেলেকে কে বড় করে তুলল, কবি হেলাল হাফিজ করে তুলল? সে এক বিদূষী রূপবতী। তার কবিসত্তা নিয়ে কথা উঠলেই হেলাল ভাই স্মরণ করেন দু’জন মানুষকে। একজন তার কবি বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার। আরেকজন সেই বিদূষী রূপবতী। সবিতা সেন। পাড়াতুতো দিদি, স্কুল মিস্ট্রেস। কবি যে হেলাল হাফিজ, একাধারে তার মা, বড় বোন এবং প্রেমিকা। হয়ে ওঠা এক আশ্চর্য গল্প। হেলাল ভাই যখন বলেন গল্পটা, দেখা যায় সবিতা সেনকে, ভোরের নদীর পাড় দেখা যায় এবং কচুরিপানা ফুলের জাদুকরি রং। ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইটা নিয়ে আর দুটা কথা বলি। আমার আমীরুল ভাই (আমীরুল ইসলাম) হসপিটালে। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম আজ সন্ধ্যায়। দর্শনার্থী এক কবি কেবিন থেকে বেরিয়ে কথায় কথায় ‘বেদনাকে...’ নিয়ে পড়লেন। নাহ্! হেলাল হাফিজ এই বইটায় নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি! আমার আবার লেথোলজিকা হল। বিশেষ একটা শব্দ আমি ভুলে গেলাম। বারবার ভুলে যাই। না হলে কবি সাহেবকে বলতাম। আরে, নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে কেউ? গেছে কখনও? আমরা এমন অনেক চটকদার কথা বলি, অর্থ হয় না, কিছু হয় না। বিশ্বাস করি তর্কে বহু দূর। তর্ক করি না। হেলাল হাফিজের শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটা? ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইয়ের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’? ‘অস্ত্র সমর্পণ’? ‘বাম হাত তোমাকে দিলাম’? না ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইয়ের ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’? ‘লীলা’? ‘কৃষ্ণপক্ষ’?

শ্রেষ্ঠ কবিতা। গোলমেলে ব্যাপার, বিরক্তিকর এবং সর্বতোভাবেই বাণিজ্যিক ধারণা। কবি তার সর্বস্ব নিয়েই কবি। সব শব্দ সব অক্ষর নিয়ে। তাহলে শ্রেষ্ঠ কবিতা নির্বাচন বাদ থাক। ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বাইয়ের ‘বাসনা’ কবিতারটা,

আগামী, তোমার হাতে

আমার কবিতা যেন

থাকে দুধে-ভাতে।

কী দারুণ উচ্চারণ! পৃথিবীর সব কবির হয়ে এক কবির।

শব্দ সব প্রকাশ করতে পারে না। যতটুকু পারে, মানে আমি যতটুকু পারি,

লিখলাম, এই হলেন আমার হেলাল ভাই। আমার কবি হেলাল হাফিজ।

পুনশ্চ বহুদিন আগে হেলাল ভাই আমাকে তার দ্বতীয় কাব্যগ্রন্থের কথা বলেছিলেন। নাম ঠিক করে রেখেছেন। সেটা ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ না, আরেকটা নাম। সেই নামটা আমার মনে আছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম