চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত স্লোগান
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাঙালির আত্মপরিচয়জ্ঞাপক স্লোগান ‘জয় বাংলা’ আজ একাকার হয়ে মিশে আছে প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে; শিরা-উপশিরায়, ধমনিতে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীজমন্ত্র হিসাবে কাজ করেছে এ স্লোগান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যে গতি ও শক্তি সঞ্চার করেছিল, তার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই। ছোট্ট দুটি শব্দের একটি স্লোগান কীভাবে পুরো একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে; কীভাবে একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে; কীভাবে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষকে একই চেতনার আলোকে উজ্জীবিত করে-‘জয় বাংলা’ স্লোগান তারই একটি বড় দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলা শব্দ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু ছাড়া জয় বাংলা যেমন অর্থহীন, তেমনি জয় বাংলা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শব্দটি পূর্ণতা পায় না। জয় বাংলা কোনো দলের স্লোগান নয়, এ স্লোগান মুক্তিকামী বাঙালির। জয় বাংলা আজ আমাদের জাতীয় স্লোগান।
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উদ্ভাবনের পেছনে যে ব্যক্তিটি জড়িয়ে আছেন, তিনি হলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগানটি নজরুলের কবিতা থেকে নিয়েছিলেন। ... নজরুল প্রেরণা ও চেতনার কবি। তার কবিতা ও গানে অসাম্প্রদায়িকতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।’ এর আগে ২০ এপ্রিল ২০১৩ নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র, কুমিল্লা উদ্বোধনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘... the slogan ‘Joy Bangla’ came from rebel poet Kazi Nazrul Islam and it is the slogan of the entire nation’.
মাদারীপুরের শান্তি-সেনা-বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র দাস (১৮৯৯-১৯৫৬) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী। পূর্ণচন্দ্র দাসের আত্মত্যাগ, স্বাজাত্যবোধে মুগ্ধ হয়ে তার কারামুক্তি উপলক্ষ্যে ১৯২৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে নজরুল কবিতাটি লেখেন, যা ১৯২৪ সালে তার ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ পায়। ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুলের কারামুক্তি ঘটে। তার অন্তত দুমাস আগে মুক্তি পান পূর্ণচন্দ্র দাস। পূর্ণচন্দ্র মুক্তি পাওয়ার সময় নজরুল জেলে বসে কবিতাটি লেখেন। এ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ‘জয় বাঙলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। পঞ্চম স্তবকের তৃতীয় চরণে উল্লেখ আছে ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র’। এ স্লোগানের উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি তথ্য পাওয়া যায় কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত নবপর্যায় (১৯৪০) ‘নবযুগ’ পত্রিকার ৩ বৈশাখ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ (১৯৪২) সংখায় ‘বাঙালির বাঙলা’ নামে প্রকাশিত প্রবন্ধে।
২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসাবে গ্রহণের জন্য মহামান্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়ে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পর জাতীয় দিবসগুলোতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সব কর্মকর্তা সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে যাতে ‘জয় বাংলা’ বলেন এবং সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন, সেই আদেশ প্রদান এবং তা পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসাবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই বলা যায়, যে স্বপ্নের কথা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে বলেছেন, ১৯৫১ সালে সে স্বপ্ন দেখেছেন বঙ্গবন্ধু।
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন : ডিসি (ট্রাফিক), গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ
