সরকারি ঋণ ও মূল্যস্ফীতিসহ ৫ সূচক
নিম্ন থেকে বেরিয়ে মধ্যম ঝুঁকিতে দেশ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সরকারের দেশি ও বিদেশি ঋণের স্থিতি এখন ‘মধ্যম’ ঝুঁকিতে পৌঁছে দিয়েছে দেশকে। ঋণের অঙ্ক কম থাকায় এর আগে ঝুঁকির মাত্রা ছিল ‘নিম্ন’। ঋণের স্থিতি (মোট ঋণ) ছাড়াও উচ্চ সুদহার ও টাকার অবমূল্যায়ন (সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ) বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতিকে। ফলে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক ও রাজস্ব খাত, মুদ্রা বিনিময় হার এবং বাহ্যিক অবস্থার প্রেক্ষাপটও দেশকে মধ্যম ঝুঁকিতে ফেলছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারের মধ্যমেয়াদি (২০২৫-২৬ থেকে ২০২৬-২৭) ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্রে এ মূল্যায়ন করা হয়েছে।
আগামী তিন অর্থবছর সরকারের ঋণ গ্রহণের কৌশল এবং দেশি ও বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে কতটা ঝুঁকি অবস্থায় আছে-এসব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে ওই কৌশলপত্রে। প্রতি তিন বছর অন্তর এটি প্রণয়ন করা হয়।
জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, বৈদেশিক ঋণের চেয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের ঝুঁকি কম। বৈদেশিক ঋণে মুদ্রা বিনিময় হার ও সুদহার-এ দুটি ঝুঁকি থাকে। উচ্চ সুদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও বাজেট প্রণয়নের কারণে সুদের হার বাড়বেই। আর ইরান-ইসরাইল যুদ্ধসহ বিশ্বপরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে অবস্থান করবে, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না বলে যোগ করেন তিনি। তার মতে, যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়লে এর প্রভাব আমাদের ওপর পড়বে। এছাড়া স্থিতিশীল থাকলেও মুদ্রা বিনিয়ম হার ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে প্রবাসীরা বিদেশে থাকতে না পারলে রেমিট্যান্স কমবে। এর সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় হার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে বলেন, খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিলের বিবেচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। সেখানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার আবেদন জমা পড়ছে। তা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আরও কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কারণ, এসব আবেদন নিষ্পত্তি না করলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে। সার্বিক দৃষ্টিতে পাঁচটি সূচকে মধ্যম ঝুঁকির কথা বলা হলেও মূল্যস্ফীতি আরও বেশি হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঋণব্যবস্থা নিয়ে যে কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে, সেটি মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মডেল অনুসরণ করা হয়। সেখানে বলা হয়, সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা বাড়াতে একটি ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থাপনা কাঠামোর দিকে অগ্রসর হতে হবে। এই কাঠামোর অধীনে ঋণ ব্যবস্থাপনার সব দিক, ট্রেজারি সিকিউরিটিজ ইস্যু, জাতীয় সঞ্চয়পত্র এবং বৈদেশিক ঋণের তত্ত্বাবধান করা হবে। এজন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত ইউনিট গঠন করে অর্থ বিভাগের অধীনে পরিচালনা হওয়া উচিত।
ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্রে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, সরকারের মোট ঋণের অঙ্ক ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৩৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। এর মধ্যে দেশি ঋণের অঙ্ক ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। দেশীয় ঋণ প্রসঙ্গে বলা হয়, কয়েক বছর ধরে দেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ঋণের ৬৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ দাঁড়িয়েছে দেশি ঋণ। এটি জিডিপির ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। কৌশলপত্রে একই সময়ে বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক দেখানো হয় ৭ লাখ ৯৯ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
ঋণের ঝুঁকির কথা তুলে ধরে আরও বলা হয়, মূলত ঋণের বেশির ভাগই স্থানীয় মুদ্রায় অর্থাৎ টাকায় এবং বৈদেশিক ঋণ দীর্ঘমেয়াদি। তবে বৈদেশিক ঋণের চেয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের ব্যয় অনেক, বিশেষ করে দেশি ঋণের অস্বাভাবিক সুদ ব্যয় অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলছে। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের ওপর বেশি মাত্রা নির্ভরতা বেড়েছে। ফলে মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকিও বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে একটি দেশ তাদের জিডিপির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ করাকে ঝুঁকিমুক্ত দেখা হয়। কিন্তু ৫৫ শতাংশের ওপর ঋণ অনুপাত অতিক্রম করলে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে দেশটি সে হিসাবও করা হয়। একটি দেশের ঋণের বোঝা বেশি হলে ওই দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া কাক্সিক্ষত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ ও রপ্তানি আয় না হওয়ায় এ ঋণের অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পায়।
কৌশলপত্রে মুদ্রাস্ফীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, বর্তমান দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি অব্যাহত আছে এবং মুদ্রানীতি কঠোর রয়েছে। ফলে দেশীয় বাজারে উচ্চ সুদের হার বিরাজ করছে। সার্বিক অবস্থায় মূল্যস্ফীতি মধ্যম ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া সরকারের আর্থিক খাতে সুদ ব্যয়ের চাপ রয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় সুদের হার বেশি থাকলেও বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার আরও অবমূল্যায়ন হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় টাকার অবমূল্যায়ন ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ হয়েছে। বিনিময় হার এবং সুদের হার অর্থনীতিতে একটি মাঝারি ধাক্কা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এটি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকে ব্যয়বহুল করে তুলতে পারে।
আর্থিক খাত প্রসঙ্গে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে উচ্চ অনাদায়ি ঋণ এবং তারল্য সংকট আর্থিক খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এটি মাঝারি ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া তারল্য সংকটের কারণে সরকারের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিতে পারে।
কৌশলপত্রে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে; একদিকে উচ্চ সুদের হারের কারণে বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে, অন্যদিকে তেলের মতো পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এই ধাক্কাগুলোর কারণে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে কম অর্জন হবে।

