স্বজন মুক্তগদ্য
শীতলক্ষ্যার অপরূপ রূপ
জাহাঙ্গীর ডালিম
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যখনই সময় হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে ঘুরে বেড়াই আমি। এ শীতলক্ষ্যা নদীতে কত গুণী কবিরা এসেছিলেন। কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য এ নদী। আবু হাসান শাহারিয়ার, নুরুল হুদা, আসাদ চৌধুরীরসহ অনেক নামিদামি কবিরা এ শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, লিখেছেন কবিতা।
শীতলক্ষ্যা নদীটি ব্রহ্মপুত্র নদের একটি উপনদী। গতিপথের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পরে নারায়ণগঞ্জের পূর্ব দিক হয়ে কালাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। গাজীপুর জেলার টোক নামক স্থানে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে একটি ধারা বানার নামে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে লাকপুর নামক স্থানে শীতলক্ষ্যা নাম ধারণ করে। বৃহত্তর ঢাকা জেলার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীটি। এ নদীর মোট দৈর্ঘ্য ১১০ কিমি, প্রস্থ নারায়ণগঞ্জের কাছে ৩০০ মিটার, কিন্তু ওপরের দিকে আস্তে আস্তে কমে গিয়ে হয়েছে প্রায় ১০০ মিটার। নদীটি নাব্য এবং সারা বছরই নৌ চলাচলের উপযোগী। শীতলক্ষ্যার ভাঙন প্রবণতা কম।
বাংলাদেশের বিখ্যাত মসলিন শিল্প শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। বর্তমানেও উভয় তীরে প্রচুর পরিমাণে ভারি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। অধুনালুপ্ত পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল ‘আদমজী জুট মিল’ শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত ছিল। এ নদীর তীরে ঘোড়াশালের উত্তরে পলাশে তিনটি এবং সিদ্ধিরগঞ্জে একটি তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র অবস্থিত। বাংলাদেশের অন্যতম নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জ বন্দর ও শহর এ নদীর তীরে অবস্থিত। শীতলক্ষ্যা তার পানির স্বচ্ছতা এবং শীতলতার জন্য একদা বিখ্যাত ছিল। বছরের পাঁচ মাস নদীটি জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্রভাবিত থাকে, কিন্তু কখনোই কূল ছাপিয়ে যায় না। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যা নদী বয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে। ইতিহাস ও ঐতিহ্য ছড়িয়ে রয়েছে এ নারায়ণগঞ্জ জেলায়। উপজেলার সংখ্যা ৭টি। এগুলো হলো নারায়ণগঞ্জ সদর, ফতুল্লা, আড়াইহাজার, সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ, বন্দর আর সিদ্ধিরগঞ্জ। এ জেলার আয়তন প্রায় ৭৫৯ বর্গকিলোমিটার। লক্ষ্মীনারায়ণ ঠাকুর নামে এক হিন্দু জমিদারের নামানুসারে নারায়ণগঞ্জ জেলার নামকরণ করা হয়েছে। এ জেলায় আছে ঈশাখাঁর দুর্গ এবং বিবি মরিয়মের মাজার।
ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর হিসাবে সমধিক খ্যাত। এখানকার দুর্গ, তোলারাম কলেজ, কদমরসুল আপনাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করবে। ঢাকা থেকে সকালে রওনা করে সারাদিন নারায়ণগঞ্জ ঘুরে ফিরে দেখে সন্ধ্যায় ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু বন্দর শহর নারায়ণগঞ্জ দেখে কিছুতেই ফিরে আসতে মন চাইবে না। তিন থেকে চারদিন ভ্রমণ করে কিংবা একদিনেই উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তিগুলো দেখে নিতে পারেন।
শহরের উত্তরদিকে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে একটি দুর্গ দেখবেন। এটি ঈশা খাঁ নির্মাণ করেছিলেন। নিচে থেকে যাত্রাপথে সুড়ঙ্গপথ তৈরি করেছিলেন। এ সুড়ঙ্গ দিয়ে লালবাগ দুর্গে যাওয়া যেত। এ দুর্গ থেকে কিছু দক্ষিণে অবস্থিত মরিয়ম মসজিদটি বাংলার সুবেদার নবাব শায়েস্তা খাঁন তার কন্যার নামে তৈরি করেছিলেন। সোনাকান্দা দুর্গটি প্রায় দুশ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। চারদিকেই দেওয়ালে ছোট ছোট ‘দূরদৃষ্টি ঘর’ দেখতে পাবেন। এ ফাঁক দিয়ে সৈন্যরা দূর থেকে কেউ আসছে কি না তা লক্ষ্য করতেন। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে সোনাকান্দা দুর্গ। সতেরো শতকের প্রথমদিকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা জাহাজে করে বাংলাদেশে এসে ডাকাতি করত। তাদের ঠেকানোর জন্য সোনাকান্দা দুর্গ তৈরি করা হয় সতেরো শতকের প্রথম দিকেই।
নারায়ণগঞ্জের প্রাচীন শাহী মসজিদটিও আকর্ষণীয়। শাহী মসজিদ ঈশা খাঁর বিস্ময়কর অবদান। এটি বাংলার প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। শীতলক্ষ্যার ওপারেই নবীগঞ্জের কদমরসুল। জানা যায়, ঈশা খাঁর প্রপৌত্র দেওয়ান মনোয়ার খান এখানে একটি ইমারত তৈরি করেন।
এবার ফিরে আসুন নারায়ণগঞ্জে। তোলারাম কলেজ, পাটের গুদাম, রেলস্টেশন ঘুরে ঘুরে দেখুন। নদীর ঘাটে রয়েছে লঞ্চ আর নৌকার ছড়াছড়ি। শীতলক্ষ্যায় নৌবিহারও করতে পারেন। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত বিখ্যাত বন্দরশাহী মসজিদও দেখতে পারেন। এর কাছেই তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁও অবস্থিত। সুলতান মাহমুদ শাহের ছেলে সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের রাজত্বকালে ১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দে বাবা সালেহ কর্তৃক এ মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদ-শীর্ষে একটি বিশালাকৃতির গম্বুজ রয়েছে।
ঈসা খাঁর রাজধানী সোনারগাঁও ঘুরে দেখতে আসতে পারেন শীতলক্ষ্যার তীরে নারায়ণগঞ্জ শহরে। ঢাকা শহর থেকে সোনারগাঁও ১৫ মাইল আগে অবস্থিত। এককালে এর পশ্চিমদিক দিয়ে বয়ে যেতে ব্রহ্মপুত্র নদ। যেখান থেকে উৎপত্তি বহু কিংবদন্তির সাক্ষী শীতলক্ষ্যার।
সভাপতি, স্বজন সমাবেশ, নারায়ণগঞ্জ
