স্বজন মুক্তগদ্য
স্মৃতির পাতায় অমলিন
নুসরাত রুষা
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কয়েক বছর আগে মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। সম্পর্ক ভাঙার কষ্টে যেন বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠছিল। তখন মনে হলো-এ কষ্ট যদি মনের ভেতর জমিয়ে রাখি তবে তা আরও বেড়ে যাবে। তাই হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম, বেরিয়ে পড়তে হবে। টাকা ছিল না, তবু ধার করে ভ্রমণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।
একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে শুধু বললাম, ‘দোস্ত, আমার ব্রেকআপ হইছে। ক্যাম্পাসে থাকলে আর ভালো লাগবে না।’
বন্ধুটি বিন্দুমাত্র দেরি না করে ট্রেনের টিকিট কেটে দিল। দুপুর দুইটার বনলতা এক্সপ্রেসে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ট্রেনের জানালার পাশে বসেছিলাম, পাশের সিটে ছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। ভ্রমণের শুরুতেই আলাপ হলো। ভীষণ আন্তরিক মানুষ। টাঙ্গাইলে পৌঁছানো মাত্র চারপাশের সবুজ প্রকৃতি যেন আমাকে নতুনভাবে স্বাগত জানাল। বুকের ভেতরের কষ্টটা ধীরে ধীরে হালকা হতে লাগল। নাটোরের স্টেশনগুলো, চলনবিলের অপরূপ সৌন্দর্য-সব যেন আমার চোখে ধরা দিল এক নতুন আলোয়। শিমুল ফুলের মৌসুম ছিল তখন; রেললাইনের ধারে লাল শিমুল গাছে প্রকৃতি সেজে উঠেছিল ছবির মতো।
রাতের অন্ধকারে অবশেষে পৌঁছালাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক পরিচিত আপুর হলে রাত কাটালাম। পরদিন সকালে বের হলাম ইতিহাস ছোঁয়ার জন্য। প্রথমেই গেলাম বগুড়ার মহাস্থানগড়। অবিরাম বৃষ্টির ভেতরেও সেই প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ আমার মনে দাগ কাটল। সেখান থেকে ছুটলাম পাহাড়পুরের উদ্দেশ্যে।
নওগাঁর দীর্ঘ পথ এড়িয়ে জয়পুরহাট হয়ে যাওয়া যায় মাত্র বারো কিলোমিটার। জয়পুরহাটের রাস্তায় দুপাশে গাছগাছালির সারি, ভেজা মাটির ঘ্রাণ আর বৃষ্টির ছোঁয়া-সবকিছু এক স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করেছিল। কিন্তু বিকাল পাঁচটার পর পাহাড়পুরে পৌঁছে দেখি, গেট বন্ধ। দারোয়ানরা কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। তখন এক কর্মকর্তা এগিয়ে এলেন। কাকতালীয়ভাবে তার বাড়িও আমার এলাকায়। কথাবার্তার ফাঁকে তিনি আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিলেন। অল্প কিছুক্ষণেই চোখে ভেসে উঠল সবুজে মোড়া পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মহিমা।
ফেরার পথে আবার নতুন বিপদ। অটোচালক ইফতার করতে বাড়ি চলে যেতে চাইল, রাত বাড়ছে অথচ আর কোনো বাহন নেই। অবশেষে স্থানীয় কিছু লোক বলতেই সে রাজি হলো, আমাদের জয়পুরহাটে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু সেদিন উত্তরবঙ্গের রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি রাজশাহীর কোনো বাস নেই, আছে শুধু বগুড়াগামী বাস। আমরা টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। কিন্তু একঘণ্টা বসেও বাস ছাড়ল না। শেষে কাউন্টারের লোকজন জানাল, এত রাতে বগুড়ায় গিয়ে ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। বরং রাত এগারোটায় পঞ্চগড় থেকে আসা ট্রেনে নাটোরে গিয়ে সেখান থেকে বাস ধরাই উত্তম।
আবার স্টেশনে ফিরে এলাম। রাত তখন আটটা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মসজিদে নারীদের নামাজের জায়গায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। ট্রেন লেট। এলো রাত বারোটায়। নাটোরে নেমে চারপাশে নিস্তব্ধ অন্ধকার, অচেনা শহর, আর ভয়ভরা এক পরিবেশ। অবশেষে মাঝরাত দুইটার দিকে এক বাসে রাজশাহীতে পৌঁছালাম।
কিন্তু নতুন সমস্যার মুখোমুখি-রাতবিরেতে কোনো মেয়েদের হলে প্রবেশাধিকার নেই। তাই আমরা এক হোটেলে গিয়ে খাবার খেলাম। তারপর ঠান্ডা রাতে প্যারিস রোডের বেঞ্চে বসে কাটালাম দীর্ঘ সময়। মশার যন্ত্রণা, শীতের কষ্ট, নিঃসঙ্গতা-সব মিলিয়ে সেই রাত যেন জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত হয়ে রইল স্মৃতিতে।
ভোর হয়ে এলে, যখন রাবির হলের দরজা খুলল, তখন ব্যাগ গুছিয়ে স্টেশনের পথে রওনা দিলাম। আমার পরিচিতরা বারবার বলল, ‘আরও কয়েকদিন থেকে যাও।’ কিন্তু হাতে টাকা ছিল না। তাই সকাল সাতটার ট্রেনে ঢাকা ফিরে এলাম।
সেই ভ্রমণ আমার জন্য ছিল এক মোড় ঘোরানো অভিজ্ঞতা। প্রেমভাঙার কষ্ট ভুলতে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু পেলাম জীবনের কঠিন এক শিক্ষা। বুঝলাম-প্রকৃতি, ভ্রমণ আর মানুষের অচেনা আন্তরিকতা মানুষকে মানসিকভাবে শক্ত করে তোলে। যার জন্য বেরিয়েছিলাম, তার স্মৃতি কদিনেই মিলিয়ে গেল; কিন্তু যে বন্ধুটা পাশে ছিল, যে কষ্ট আর আনন্দ ভাগাভাগি করেছিল, সে-ই আজ স্মৃতির পাতায় অমলিন রয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
