Logo
Logo
×

স্বজন সমাবেশ

স্বজন মুক্তগদ্য

একজন মুক্তিযোদ্ধার শিক্ষক হয়ে ওঠার গল্প

Icon

দেওয়ান সামছুর রহমান

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৫৪ সালের ২ মে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার হাইজাদী ইউনিয়নের রাইনাদী আতাদি গ্রামে জন্ম নেন গিয়াসউদ্দিন মিয়া। পিতা অলিউল্লার স্নেহ আর গ্রামীণ প্রকৃতির সহজ-সরল পরিবেশে বড় হতে হতে তিনি বুঝতেও পারেননি, একদিন তার জীবনই হয়ে উঠবে স্বাধীনতার অগ্নিগর্ভ সময়ের সাক্ষ্য। আর পরবর্তীকালে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবেন হাজারও শিশুর মধ্যে।

১৯৭১ সাল। এসএসসি পরীক্ষার্থী গিয়াসউদ্দিন তখন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত; কিন্তু সময় ছিল ভয়াবহ। দেশজুড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে মুক্তির দাবানল। পরীক্ষার খাতা নয়, তখন মুখে তুলে নিতে হয়েছে দেশের জন্য লড়াইয়ের শপথ। পরীক্ষাটি স্থগিত হলো; কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি। মন-প্রাণে জন্ম নেয় একটাই সিদ্ধান্ত-দেশ স্বাধীন হোক, তারপরই হবে নিজের পরীক্ষা।

এ সিদ্ধান্ত তাকে নিয়ে যায় এক অনিশ্চিত; কিন্তু দৃঢ় পথের দিকে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ভারতে পাড়ি জমান তিনি। জাঙ্গালিয়া থেকে বাতাকান্দি হয়ে কুমিল্লার দেবীদ্বারের দিঘিরপাড়ে দুদিন অবস্থান। তারপর এক অন্ধকার রাতে হাতিমারা বর্ডার পেরিয়ে সারাদিন হাঁটা, ক্লান্তি ভুলে ট্রাকে করে পৌঁছে গেলেন আগরতলার কংগ্রেস ভবনে। সেখানে ছিল হাফানিয়া ক্যাম্প। আট ভাগে বিভক্ত সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিনি ছিলেন এক থেকে দেড় মাসের কঠোর ট্রেনিংয়ে। পাশে ছিলেন সহযোদ্ধা বারদীর গোয়ালপাড়ার নাসির প্রফেসর, আর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন উদয়দী গ্রামের মোতালেব মাস্টার। বিশ সদস্যের সেই টিমে ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মিয়া।

প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরে তারা যোগ দেন বিভিন্ন অপারেশনে। রূপগঞ্জের ভুলতার সাওঘাট ছিল তাদের যুদ্ধকালীন অবস্থান। গুলির শব্দে ভোর, লুকিয়ে থাকা দুপুর-সবকিছুর মধ্যেই ছিল অবিচল দেশপ্রেম।

দেশ স্বাধীন হলো, যুদ্ধ শেষ; কিন্তু গিয়াসউদ্দিন মিয়ার লড়াই তখনো শেষ হয়নি। শুরু হলো জীবনের আরেক নতুন সংগ্রাম-স্বশিক্ষার ও শিক্ষাদানের।

১৯৭২ সালে তিনি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম বিভাগে এসএসসি উত্তীর্ণ হন। এরপরই নিজের গ্রাম আতাদিতে প্রতিষ্ঠা করেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই ছোট্ট বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক ছিলেন তিনি নিজেই। এক হাতে পড়াশোনা, অন্য হাতে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা-এ দুই দায়িত্বই বয়ে বেড়িয়েছেন সমান নিষ্ঠায়। যুদ্ধক্ষেত্রের সাহস আর শৃঙ্খলা যেন তার শিক্ষকতার প্রতিটি মুহূর্তে লেগে রইল।

সময় গড়াল। বিদ্যালয়টি পরবর্তীকালে সরকারি হলো। তিনি বদলি হলেন বিভিন্ন স্কুলে, তবু শিক্ষকতার মায়া তাকে কখনো ছেড়ে যায়নি। শিশুদের হাসিমাখা মুখ, তাদের দুষ্টুমি, শেখার আগ্রহ-এসবই হয়ে উঠেছিল তার জীবনের নতুন যুদ্ধের হাতিয়ার। সর্বশেষ তিনি ২০১৪ সালে প্রভাকরদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।

জীবনের শেষ প্রান্তে যখন দাঁড়িয়ে, তখনো তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা মানুষ। ২০১৬ সালে হজব্রত পালন করেন। এক পুত্র ও চার কন্যাকে রেখে যান। যারা প্রত্যেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার মতোই তারা শিক্ষার মশাল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।

২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি গিয়াসউদ্দিন মিয়া পরপারে পাড়ি জমান। তিনি রেখে গেছেন এমন এক জীবনগল্প-যার একদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অন্যদিকে শিক্ষার জ্যোতির্ময় আলো। তিনি ছিলেন যোদ্ধা, যিনি রাইফেল নামিয়ে হাতে নিলেন খাতা-কলম। যুদ্ধের পাঁজর ভাঙা সময় থেকে উঠে এসে শিশুদের স্বপ্ন বুনে তিনি প্রমাণ করে গেছেন-যে মানুষ দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে, তিনি দেশের ভবিষ্যৎও গড়তে পারেন। এমন আলোকিত মানুষের ছোঁয়ায়, তাদের দেখানো পথের মাধ্যমে দিক খুঁজে পাক এ সমাজ, এ দেশ, এ জাতি।

সভাপতি, স্বজন সমাবেশ, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) শাখা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম