Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

অক্টোবর স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস

স্তন ক্যানসার কোনো গোপন রোগ নয়

Icon

ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্তন ক্যানসার কোনো গোপন রোগ নয়

ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবছর অক্টোবরকে বিশ্বব্যাপী স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসাবে পালন করা হয়, যা নীরব এ ঘাতক রোগটির বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির একটি শক্তিশালী মাধ্যম। কয়েক দশক ধরে, প্রতীকী গোলাপি ফিতা স্তন ক্যানসার সচেতনতার জন্য সার্বজনীন প্রতীক হয়ে উঠেছে।

* কেন সচেতনতা জরুরি

▶ নীরব ঘাতক : প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায়ই কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। যেদিন ব্যথা বা চাকা স্পষ্ট অনুভূত হয়, সেদিন হয়তো রোগ অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

▶ লজ্জা ও ভ্রান্ত ধারণা : স্তন নিয়ে কথা বলতে লজ্জা, ‘আমার হবে না’ এ ভ্রান্ত ধারণা, বা চিকিৎসার ভয় অনেককে জীবনরক্ষাকারী স্ক্রিনিং থেকে দূরে রাখে।

▶ জ্ঞানের অভাব : কীভাবে নিজেকে পরীক্ষা করবেন, কখন ডাক্তার দেখাবেন, স্ক্রিনিং কী এ সহজ জ্ঞানটুকুর অভাবই অনেক সময় মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে।

প্রতি আটজন মহিলার মধ্যে একজনের স্তন ক্যানসার হতে পারে এবং আক্রান্ত প্রতি ৩৬ নারীর মধ্যে মৃত্যুর আশঙ্কা একজনের।

স্তন ক্যানসার হলো অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন রোগ। মানবদেহের যে কোনো কোষের অস্বাভাবিক বিভাজন ও বৃদ্ধিই মূলত ক্যানসার। স্তন হলো লাখ লাখ কোষের সমন্বয়ে গঠিত একটি অঙ্গ যার একটি কোষের অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক বিভাজন থেকে স্তন ক্যানসার বা টিউমারের উৎপত্তি। স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়। সেটি রক্তনালির লসিকা (কোষ-রস) ও অন্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এ ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই হলো ক্যানসার। স্তনের টিউমার সাধারণত দুধরনের হয়ে থাকে-একটি হচ্ছে বিনাইন (নির্দোষ) আরেকটি ম্যালিগন্যান্ট (ক্ষতিকর)। বিনাইন টিউমার কোনো ভয়ের বিষয় নয়। কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট টিউমার খুবই ভয়ানক। কারণ, এটিই হচ্ছে স্তনের ক্যানসার যা অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে আক্রমণ করে।

* অপরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি

▶ লিঙ্গ : নারী-পুরুষ উভয়ই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে তবে নারীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ।

▶ বয়স : নারীদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়তে থাকে। চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।

▶ জিনগত : BRCA1 ও BRCA2 জিনের মিউটেশনের কারণে ৫-১০ শতাংশ স্তন ক্যানসার হয়ে থাকে।

▶ পারিবারিক ইতিহাস : যেসব নারীর রক্ত সম্পর্কিত কোনো আত্মীয় (মা, মেয়ে, বোন) ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

▶ হরমোনাল : যাদের ১২ বছর বয়সে বা তার আগে মাসিক শুরু হয় এবং পঞ্চাশ বছর বয়সের পর বন্ধ হয় তাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে ।

* পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি

▶ জীবনযাপনের ধারা : স্থূলতা, ধূমপান, মদ্যপান।

▶ প্রসব ও স্তন্যদান : দেরিতে সন্তান ধারণ, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ালে কিংবা নিঃসন্তান নারীদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি থাকে।

▶ খাদ্যাভ্যাস : সবজি ও ফলজাতীয় খাবার কম খেলে এবং চর্বিজাতীয় ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার বেশি খেলে এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

▶ শারীরিক : শরীরের অতিরিক্ত ওজন এবং শারীরিক পরিশ্রমবিহীন জীবনযাপন ঝুঁকি বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ।

* স্তন ক্যানসারের সম্ভাব্য লক্ষণ

কমবেশি সব মহিলাদের স্তনেই লাম্প বা দলা বা চাকা অথবা পিণ্ড থাকে। এর মধ্যে কয়েকটি ক্যানসারাস ও কয়েকটি নন-ক্যানসারাস। যে লাম্পগুলো টিপলে শক্ত লাগে এবং অবস্থান পরিবর্তন করে না, সেগুলো ক্যানসারের উপসর্গ হতে পার। এ ছাড়া আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে-

▶ বগলে লাম্প বা পিণ্ড।

▶ স্তনে ব্যথা অথচ তা মাসিক চক্র সম্পর্কিত নয়।

▶ স্তনের আকারে অস্বাভাবিক পরিবর্তন।

▶ স্তনের রং পরিবর্তন। স্তন হঠাৎ লাল কিংবা লালচে রঙের হয়ে যাওয়া।

▶ স্তনের ত্বক অস্বাভাবিক কুঁচকে যাওয়া।

▶ স্তন বৃন্ত থেকে তরল পদার্থের নির্গমণ হওয়া।

▶ স্তনের ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়া।

* স্ব-পরীক্ষা পদ্ধতি (সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন)

প্রতিমাসে পিরিয়ড সেরে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে একবার করে এ পরীক্ষা করা যায়। দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে-

▶ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা : দুইবাহু মাথার ওপরে বা পেছনে উঁচিয়ে ধরে, হাত কোমরে চেপে দাঁড়িয়ে স্তনের আকার, আকৃতি ও রং পরিবর্তন লক্ষ করুন।

▶ স্পর্শ পদ্ধতি : দুই অবস্থানে (বিছানায় শুয়ে এবং গোসলের সময়) এ পরীক্ষাটি করা যায়। হাত দিয়ে স্তনের প্রতিটি অংশ সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখুন কোনো চাকা বা অস্বাভাবিকতা অনুভব করা যায় কিনা।

▶ ২০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি তিন বছরে একবার এবং চল্লিশ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিবছরে একবার পরীক্ষা করানো উচিত একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা। ম্যামোগ্রাম স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের জন্য স্বর্ণমান হিসাবে রয়ে গেছে, বিশেষ করে ৪০ বছরের বেশি বয়সি মহিলাদের জন্য।

* চিকিৎসার অগ্রগতি

গত কয়েক দশকে স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে থেরাপি, টারগেটেড থেরাপি পাওয়া যাচ্ছে যা ক্যানসার সেল ধ্বংস করতে পারে, নন ক্যানসার বা নরমাল সেলকে ক্ষতি কম করে।

* ভেঙে ফেলুন মিথের বেড়াজাল

▶ ‘স্তনে ব্যথা মানেই ক্যানসার’ মিথ্যা। বেশির ভাগ ব্যথার অন্য কারণ থাকে। তবে অবহেলা করবেন না।

▶ ‘পরিবারে কারও নেই, আমার হবে না’ মিথ্যা। বেশির ভাগ স্তন ক্যানসারেরই পারিবারিক ইতিহাস নেই।

▶ ‘ম্যামোগ্রামে ব্যথা হয়, রেডিয়েশন ক্ষতিকর’ সামান্য অস্বস্তি হতে পারে, কিন্তু এটি অত্যন্ত নিরাপদ এবং প্রাণ রক্ষাকারী। ঝুঁকির চেয়ে সুবিধা অনেক বেশি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক (সার্জারি), পাবনা মেডিকেল কলেজ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম