গলায় কিছু আটকে গেলে কী করবেন
ডা. অপূর্ব চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পরিবারের সবাই টেবিলে বসে খাচ্ছেন। এমন সময় হঠাৎ একজনের মুখ থেমে গেল, চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, দু’হাতে গলা চেপে ধরেছে যেন। মুখ থেকে কিছু একটা বের করতে চাচ্ছে! কেউ চেয়ার থেকে উঠে গ্লাস হাতে পানি এগিয়ে দিল, কেউ পিঠ চাপড়াতে লাগল, কেউ চিৎকার করে বলল-গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করাও! এমন মুহূর্ত মানে, গলায় কিছু একটা আটকে গেছে। এ ছোট্ট ঘটনাই হতে পারে জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। এমন পরিস্থিতিতে সুস্থ একজন মানুষও শ্বাসকষ্টে মুহূর্তে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। শুনতে কি ভয়ংকর! গলায় খাবার আটকে মৃত্যুবরণ! আর এমন অবস্থায় দ্রুত কয়েকটি সঠিক পদক্ষেপই বাঁচাতে পারে একটি জীবন। বছরে পৃথিবীতে প্রায় এক লাখের ওপরে মানুষ এমন করে গলায় কিছু আটকে মারা যায়। শুধু আমেরিকাতে বছরে গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ এমন দুর্ঘটনায় মারা যায়। দেখা গেছে, গলায় আটকে যাওয়ার কারণে দুর্ঘটনা কিংবা মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয় শিশুদের। বিশেষ করে ৫ বছরের নিচে শিশুদের। বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা, পিন, বোতাম, ব্যাটারি, এসব মুখে বেশি দেয় তারা।
চোকিং বা গলায় কিছু আটকে যাওয়া দৈনন্দিন একটি ঘরোয়া সমস্যা। প্রাপ্তবয়স্ক হোক আর শিশু-কিশোর হোক, যে কোনো বয়সের যে কারও এমনটি হতে পারে। এমনটি হলে প্রথম যে সমস্যাটি হয়, তা হলো-খানিক সময়ের জন্য দম বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাস নেওয়া থেকে গলায় কিছু আটকে যাওয়া, অনেক কিছুই হতে পারে। কোনো বস্তু, কিংবা কোনো খাদ্য, বা খাদ্য টুকরা গলা বা শ্বাস-প্রশ্বাসের নালিতে কোনো কারণে আটকে গেলে এমন হয়। তখন বস্তুটি বাহির থেকে নাক-মুখ দিয়ে ফুসফুসের ভেতর বাতাসের প্রবাহকে বাধা দেয়। এমন মুহূর্তে গলা বা শ্বাসনালি দ্রুত পরিষ্কার না করা হলে জীবননাশের কারণ হতে পারে। এক কথায় এটি একটি ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন।
প্রথমে কী করে বুঝবেন গলায় কিছু আটকে গেছে! দম বন্ধ হওয়ার লক্ষণগুলো শনাক্ত করুন। যেমন-কথা বলতে বা চিৎকার করতে না পারা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, দুর্বল কাশি হওয়া, ঠোঁট, মুখ বা আঙুলের ডগা নীল রঙের হয়ে যাওয়া। এবং সর্বশেষে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
এমন হলে কী করবেন ? প্রাপ্তবয়স্ক হলে তারা শ্বাসকষ্ট ফিল করছে কিনা, জিজ্ঞাসা করুন। যদি তারা মৌখিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, তাহলে বস্তুটিকে গলা থেকে বের করার জন্য জোর করে কাশি দিতে বলুন।
একটা বিশেষ পদ্ধতি এমন পরিস্থিতিতে কাজ করে ভালো। এটিকে বলে হেইমলিচ ম্যানুভার বা অ্যাবডোমিনাল থ্রাস্টস। এ পদ্ধতিতে ব্যক্তির পেছনে দাঁড়িয়ে তাদের কোমরে আপনার হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখুন। এক হাত দিয়ে মুষ্টি তৈরি করে তাদের নাভির ঠিক ওপরে রাখুন। আপনার অন্য হাত দিয়ে মুষ্টিটি আঁকড়ে ধরুন এবং ওপরের দিকে চাপ দেন। যতক্ষণ না বস্তুটি বের হয় বা ব্যক্তি অজ্ঞান না হয়, ততক্ষণ চালিয়ে যান।
যদি বস্তুটি বের না হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে বা অজ্ঞান হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে জরুরি নম্বরে কল করুন বা নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান। চেষ্টার পরও যদি বস্তুটি না বের হয়, তবে দ্রুত সিপিআর শুরু করা প্রয়োজন হতে পারে।
অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে আঙুল দিয়ে গলার ভেতরে বস্তুটি বের করতে চেষ্টা করেন অনেকসময়। এতে বস্তুটি আরও গভীরে চলে যেতে পারে। এ সময় পানি বা তরল কিছু পান করার চেষ্টা করাও বিপজ্জনক হতে পারে। তাই আতঙ্ক না হয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি এবং শরীরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করুন।
শিশুদের গলায় কিছু আটকে গেলে কী করবেন? শিশুদের, বিশেষ করে এক বছরের কম বয়সি শিশুদের গলায় কিছু আটকালে এমন পরিস্থিতিতে কী করবেন? প্রথমে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করুন। প্যানিক না হয়ে বোঝার চেষ্টা করুন। শিশু যদি কাশি বা শব্দ করতে পারে, তবে তাকে কাশি চালিয়ে যেতে বলুন। পিঠে আঘাত করুন এবং বুকে হালকা চাপ দিন। আপনার হাতের সাহায্যে শিশুর মাথা এবং ঘাড়কে সাপোর্টে রেখে শিশুর মুখটি আপনার বাহুতে রাখুন। হাতের গোড়ালি দিয়ে শিশুর কাঁধে এবং পিঠে চাপ দেন। যদি বস্তুটি সরে না যায়, তাহলে শিশুর মুখ উঁচু করে ধরে পায়ের উপর বসান। শিশুর বুকের মাঝখানে দুটি আঙুল রেখে চাপ দেন। বস্তুটি বের না হওয়া পর্যন্ত বা শিশু অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত এমন করে পিঠে আঘাত এবং বুকে চাপ প্রয়োগ বারবার করুন।
শিশুরা যাতে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়, পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন অবস্থা থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায়। এর জন্য শিশুদের খাবারকে সবসময় ছোট ছোট টুকরো করে দেবেন। খাবার খাওয়ার সময় গিলে ফেলার আগে বারবার খাবারটি চিবাতে শিশুকে উৎসাহিত করুন। এটি বার বার করতে বললে তার মধ্যে একটি অভ্যাস গড়ে তুলুন। খাওয়ার সময় শিশুদের সঙ্গে অতিরিক্ত কথা বলা বা হাসা এড়িয়ে চলুন। হাসতে হাসতে খেতে বা দৌড়ে দৌড়ে খাওয়াতে অভ্যাস করবেন না বাচ্চাদের। ঘরের ছোট ছোট বস্তুকে শিশুটির নাগালের বাইরে রাখুন। বিশেষ করে কয়েন, বোতাম এবং ছোট খেলনাগুলোর মতো ছোট জিনিসগুলো বাচ্চাদের থেকে দূরে রাখুন।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী চিকিৎসক।
