Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

হাইপোথাইরয়েডিজম রোগী যেভাবে স্বাভাবিক ও কর্মময় থাকবেন

Icon

ডা. এম এ হালিম খান

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাইপোথাইরয়েডিজম রোগী যেভাবে স্বাভাবিক ও কর্মময় থাকবেন

হাইপোথাইরয়েডিজম একটি হরমোনজনিত রোগ, যেখানে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে পারে না। থাইরয়েড হরমোন শরীরের বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ শরীরের শক্তি উৎপাদন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, হৃদস্পন্দন, হজম প্রভৃতি কাজ পরিচালনা করে। এ হরমোনের ঘাটতি হলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা কমে যায়। বিস্তারিত লিখেছেন ডা. এম এ হালিম খান

* হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণ

বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো-

▶ অটোইমিউন থাইরয়েডাইটিস (হাসিমোটস থাইরয়েডাইটিস) : এটি সাধারণ কারণ। শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজেই থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করে, ফলে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন ব্যাহত হয়।

▶ থাইরয়েড অপারেশন বা রেডিওথেরাপি : থাইরয়েড গ্রন্থি আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণের পর বা থাইরয়েড ক্যানসার ও হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসায় রেডিওআ্যাকটিভ আয়োডিন ব্যবহারের ফলে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন কমে যেতে পারে।

▶ আয়োডিনের ঘাটতি বা অতিরিক্ততা : থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে আয়োডিন অপরিহার্য। অতিরিক্ত বা ঘাটতি উভয় অবস্থাতেই সমস্যা হতে পারে।

▶ কিছু ওষুধ : লিথিয়াম, অ্যামিওডারোন ইত্যাদি কিছু ওষুধ থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে।

▶ জন্মগত : কিছু শিশু জন্ম থেকেই থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে অক্ষম থাকে।

* লক্ষণ

হাইপোথাইরয়েডিজম ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গগুলো অস্পষ্ট হতে পারে। তবে হরমোন ঘাটতি বৃদ্ধি পেলে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়-

▶ অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা : প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে কষ্ট হয়, সারাক্ষণ অলসতা ও ক্লান্তি অনুভব হয়।

▶ ওজন বৃদ্ধি : খাবারের পরিমাণ না বাড়লেও ওজন ধীরে ধীরে বেড়ে যায়, কারণ বিপাকক্রিয়া ধীর হয়ে পড়ে।

▶ ঠান্ডা সহ্য না হওয়া : হালকা ঠান্ডাতেও অস্বস্তিবোধ হয়, শরীর সবসময় ঠান্ডা লাগে।

▶ ত্বক শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যাওয়া : ত্বক রুক্ষ, শুষ্ক এবং ফেটে যেতে পারে। ময়েশ্চারাইজারেও খুব একটা উপকার হয় না।

▶ চুল পড়া ও চুল পাতলা হয়ে যাওয়া : মাথার চুল পাতলা হয়, ঝরে পড়ে এবং ভঙ্গুর হয়ে যায়।

▶ কোষ্ঠকাঠিন্য : বিপাক হ্রাসের কারণে হজম ধীর হয়, ফলে পায়খানা কঠিন ও অনিয়মিত হয়।

▶ মুখমণ্ডল ফোলা ও চোখের নিচে স্যাঁতসেঁতে ভাব : মুখ ভারী ও ফোলা ফোলা দেখায়, চোখের নিচে পাফি ভাব দেখা যায়।

▶ গলার চারপাশে ফোলাভাব (গয়েটার) : থাইরয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে গলায় ফোলাভাব দেখা যায়।

▶ মনোযোগ হ্রাস ও স্মৃতিভ্রংশ : একাগ্রতা কমে যায়, কথা বা কাজ ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।

▶ বিষণ্নতা ও মানসিক অবসাদ : মনের ওপর ভার অনুভব হয়, কোনো কিছুতেই আগ্রহ থাকে না।

▶ হৃদস্পন্দন কমে যাওয়া : হার্টবিট ধীর হয়, বুক ধড়ফড় কমে যায় বা দুর্বল অনুভব হয়।

▶ মাসিক অনিয়ম ও বন্ধ্যত্ব (নারীদের ক্ষেত্রে) : মাসিক চক্র অনিয়মিত হয় বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

▶ কর্কশ কণ্ঠস্বর : কণ্ঠস্বর ভারী বা কর্কশ হয়ে যায়।

▶ সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব : পর্যাপ্ত ঘুমের পরও ঘুম পেতে থাকে, সচলতা কমে যায়।

* মনে রাখতে হবে

এ লক্ষণগুলো একসঙ্গে দেখা না-ও যেতে পারে এবং সব রোগীর ক্ষেত্রেও এক রকম হবে না। কেউ কেউ মাত্র কয়েকটি লক্ষণ নিয়ে ভোগেন, আবার কারও ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো খুব জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

* জটিলতা

হাইপোথাইরয়েডিজম দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন-

▶ গভীর অবসাদ

▶▶ হৃদরোগ : কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়ায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে।

▶▶ বন্ধ্যত্ব : হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে গর্ভধারণে সমস্যা।

▶▶ Myxedema : এটি হাইপোথাইরয়েডিজমের চরম অবস্থা, যেখানে জীবনহানি ঘটতে পারে।

▶▶ গর্ভাবস্থায় জটিলতা : মা ও শিশুর উভয়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

* রোগ নির্ণয় পদ্ধতি

হাইপোথাইরয়েডিজম শনাক্ত করার জন্য নিচের রক্ত পরীক্ষাগুলো করা হয়-

▶ TSH (Thyroid Stimulating Hormone) : উচ্চ হলে হাইপোথাইরয়েডিজমের ইঙ্গিত।

▶ Free T4 (Thyroxine) : কম থাকলে নিশ্চিত হাইপোথাইরয়েডিজম।

▶ Anti-TPO antibodz : অটোইমিউন কারণে হলে এটি পজিটিভ হতে পারে।

* চিকিৎসা

হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা সাধারণত জীবনব্যাপী চলে, তবে সঠিকভাবে মেনে চললে রোগটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

▶ হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি

▶▶ প্রতিদিন একবার লেভোথাইরক্সিন (Levothyroxine) নামক থাইরয়েড হরমোন মুখে গ্রহণ করতে হয়।

▶▶ ডোজ নির্ধারণ করা হয় রোগীর বয়স, ওজন, লক্ষণ ও TSH মান দেখে।

▶ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ

▶▶ প্রতি ৬-৮ সপ্তাহে রক্ত পরীক্ষা করে TSH এবং Free T4 দেখা হয়, ওষুধের ডোজ ঠিক আছে কিনা নিশ্চিত করার জন্য।

▶ জীবনযাপন পরিবর্তন

▶▶ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।

▶▶ শরীরচর্চা।

▶▶ মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ।

থাইরয়েডের ওষুধ থাইরক্সিন (Thyroxine)-যাকে সাধারণত লেভোথাইরক্সিন (Levothyroxine) বলা হয় হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি পূরণের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এ ওষুধ সঠিকভাবে গ্রহণ না করলে ফলাফল আশানুরূপ হয় না। তাই থাইরক্সিন গ্রহণের সঠিক নিয়ম জানা খুব জরুরি।

নিচে থাইরক্সিন কীভাবে, কখন খেতে হয়, তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো-

* থাইরক্সিন কখন খেতে হয়

▶ সকালে খালি পেটে

▶▶ ঘুম থেকে উঠে সকালেই (সাধারণত সকাল ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে) এ ওষুধ খেতে হয়।

▶▶ খাওয়ার পর অন্তত ৩০-৬০ মিনিট কিছু খাওয়া যাবে না (খালি পেটে থাকতে হবে)।

▶▶ পানি ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া যাবে না। দুধ, চা, কফি, জুস ইত্যাদিও নয়।

▶ অন্য ওষুধ থেকে আলাদা রাখতে হবে

▶▶ থাইরক্সিন অন্য অনেক ওষুধের (যেমন-আয়রন, ক্যালসিয়াম, অ্যান্টাসিড) সঙ্গে বিক্রিয়া করতে পারে। তাই থাইরক্সিন খাওয়ার পর অন্য ওষুধ খেতে হলে অন্তত ৪ ঘণ্টার ব্যবধান রাখা উচিত।

* কীভাবে থাইরক্সিন খেতে হয়

▶ এক গ্লাস পানির সঙ্গে সম্পূর্ণ ট্যাবলেট গিলে খেতে হবে। চিবানো বা ভাঙা উচিত নয়।

▶ নির্ধারিত ডোজ অনুযায়ী প্রতিদিন নিয়মিত খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ডোজ কমানো বা বাড়ানো যাবে না।

▶ নিয়মিত একই সময়ে খেতে হবে, এতে ওষুধ শরীরে স্থির মাত্রায় কাজ করতে পারে।

* বিশেষ সতর্কতা ও পরামর্শ

▶ খাবার ও পানীয় যা এড়ানো উচিত

▶▶ দুধ, কফি, সোয়া (soy) খাবার, ও ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার ওষুধের শোষণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই থাইরক্সিন খাওয়ার কমপক্ষে ৩০-৬০ মিনিট পর এসব খেতে হবে।

▶ আয়রন ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট

▶▶ যদি আয়রন বা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে হয়, তাহলে তা থাইরক্সিন খাওয়ার অন্তত ৪ ঘণ্টা পর খেতে হবে।

▶ গর্ভবতী বা গর্ভধারণ পরিকল্পনায় থাকলে

▶▶ থাইরক্সিনের ডোজ পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে, তাই অবিলম্বে চিকিৎসককে জানাতে হবে।

* নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন

থাইরক্সিনের ডোজ শরীরের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে ঠিক রাখতে চিকিৎসক সাধারণত নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্ত পরীক্ষা করতে বলেন। যেমন-

▶ TSH (Thyroid Stimulating Hormone) এবং Free T4 পরীক্ষা।

▶ সাধারণত প্রতি ৬-৮ সপ্তাহ পরপর এ পরীক্ষা করা হয়, যতক্ষণ না হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক হয়।

* থাইরক্সিন খাওয়ার কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (অত্যধিক মাত্রায় খেলে)

▶ হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া।

▶ অস্থিরতা বা ঘুম কম হওয়া।

▶ ওজন কমে যাওয়া।

▶ অতিরিক্ত ঘাম।

▶ বুক ধড়ফড় করা।

এ উপসর্গগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডোজ কমাতে হতে পারে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম