Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

যমুনার চরে সংগ্রামে অবিচল নারীরা

Icon

মাহফুজুর রহমান, জামালপুর থেকে

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জামালপুরের বিশাল চরাঞ্চল। যেখানে প্রতি বছর নদীর খেয়ালি ভাঙন আর দখিনা হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যায় মানুষের জীবনযাত্রা। এ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় চাপটি বহন করেন এখানকার নারীরা। বন্যা, দারিদ্র্য, যাতায়াতের সংকট, সবকিছুর মাঝেই তারা লড়ে যান প্রতিদিন, নিজেদের পরিবার ও ভবিষ্যৎকে টিকিয়ে রাখতে। চরের নারীদের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো অনিশ্চয়তা।

জামালপুরের ভাঙনকবলিত যমুনার চরের অসহায় মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভাঙনকবলিত যমুনার করাল গ্রাস থেকে বাঁচার প্রত্যাশায় ধু ধু মরুভূমির মতো বালির পথ পেরিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ছোটেন নতুন ঠিকানায়। কিন্তু সর্বগ্রাসী যমুনা সেখানেও হানা দিয়ে ওদের করে সর্বস্বান্ত। এরপরও চরবাসী বেঁচে আছেন। প্রতিনিয়ত অভাব আর সীমাহীন দরিদ্রতার কবলে শুধুই ওদের হাহাকার ভাসে বাতাসে। অবিরাম জীবন সংগ্রামী যমুনার চরের নারীরা জীবনের কাছে হার মানতে শিখেননি তবু।

বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের হাজার হাজার ঘরবাড়ি, শস্য খেত বানের পানিতে তলিয়ে যায়। আয়-রোজগারহীন দরিদ্র ভূমিহীন হাজার হাজার নারীর জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। আবার ভূমিহীন নিঃস্ব নারীরা অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করেন। অপুষ্টিজনিত কারণে এ সময় রোগাক্রান্ত হয়ে অনেক বয়স্ক নারী, অকাল মৃত্যুর শিকার হন। নদী ভাঙনে বারবার বসতবাড়ি স্থানান্তর ওদের নিত্যসঙ্গী। তবু তারা চরের মাটি কামড়ে পড়ে আছেন।

যমুনার চর ঘুরে দেখা গেছে, নারীদের বেঁচে থাকার সংগ্রামী জীবন কাহিনি। জীবনের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত যমুনার চরের হাজার হাজার নারী। নানা সামাজিক বঞ্চনায় দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন তারা। অসুখে নেই চিকিৎসা। ঝাড়-ফুঁক আর কবিরাজের নির্দেশনা ওদের বেঁচে থাকার দাওয়াই। গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের অবস্থা সেই মান্ধাতার আমলের কথা মনে করিয়ে দেয়। বারবার যমুনার সঙ্গে লড়াই করে চরের নারীরা ক্লান্ত-বিপর্যস্ত। ওদের জীবন মান নিয়ে তেমন কেউ কাজ করেন না।

তবু ফসলের মাঠজুড়ে নারীদের ঘাম ঝরানো শ্রমে হাসি ফুটে চরাঞ্চলের নারীদের মুখে। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন চরাঞ্চলের নারীরা।

সংসার চালাতে প্রতিনিয়ত করতে হয় জীবনযুদ্ধ। জমিতে ফসল চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এখানকার অনেকেই। চরাঞ্চলের জমিতে নারীরা চাষাবাদ করছেন ভুট্টা, মরিচ, মিষ্টিকুমড়া, বাদাম, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন ফসল। সংসারে বাড়তি আয় করতে নারীরা গাভি পালন করেন। তাদের সেই গাভি চরাঞ্চলের খোলা মাঠে ঘাস ও লতা-পাতা খেয়ে বেড়ে ওঠেন। গৃহপালিত সেই পশু বিক্রি করে এখন অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

বিধবা নারীদের অনেকেই সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন। দুমুঠো ভাত পেটে দিতে অন্যের জমিতে শ্রম দিতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কথা হয় মুন্নিয়া চরের ৬৫ বছর বয়সি আনেছা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জমি নাই, আয়ের পথ কম। তবু সংসার তো চালাইতেই হয়।’ চরাঞ্চলে স্কুল কম, যাতায়াতও কঠিন। তাই মেয়েদের শিক্ষার হার এখনো আশানুরূপ নয়। অনেক কিশোরীই পড়ালেখা বাদ দিয়ে গৃহকর্মী বা কৃষি সহায়ক কাজে যুক্ত হয়। নোয়ারপাড়া কুলকান্দি অঞ্চলের ষাটোর্ধ্ব বয়সি আয়েশা বেগম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় নারীরা সবসময় সমাজে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হন। শিক্ষার অভাবে এখানকার নারীদের বাল্যবিয়ে নিত্যদিনের সঙ্গী।’

কথা হয় সাবধরি এলাকার ৪৭ বছরের বিধবা বানেছা বেওয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিধবা নারীদের অনেকেই সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন। দুমুঠো ভাত পেটে দিতে অন্যের জমিতে শ্রম দিতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।’ বিনিময়ে ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান তারা। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই কাজ করতে হয় যমুনার চরে। এখানে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও শোচনীয়। প্রসূতি সেবা কেন্দ্র দূরে হওয়ায় অনেক নারীই সময়মতো চিকিৎসা পান না। জরুরি মুহূর্তে নৌকার ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় থাকে না। জামালপুরের চরাঞ্চলের নারীরা শুধু প্রতিকূলতার ভুক্তভোগী নন-তারা অনবরত সংগ্রামী, সাহসী এবং পরিবর্তনের পথিকৃৎ। নদীর ভাঙন তাদের জীবনকে হয়তো ছোট ছোট অংশে ভাগ করে দেয়, কিন্তু তাদের স্বপ্ন, শক্তি আর ইচ্ছাশক্তিকে থামাতে পারে না। চরাঞ্চলের নারী মানেই প্রতিদিনের সংগ্রাম, আবার প্রতিদিনের নতুন শুরু।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম