শতফুল ফুটতে দাও
জনতার আদালতের বিচার অত্যন্ত কঠিন
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। গত কয়েক বছরে হাঁকডাক করে বলা হচ্ছিল দেশটি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছে। আরও বলা হয়েছে উত্তরণটি ঘটবে আগামী বছর ২০২৬ সালে। কিন্তু এখন বিতর্ক হচ্ছে-২০২৬ সালেই এ উত্তরণ মেনে নেওয়া ঠিক হবে কিনা। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রূপান্তরিত হলে দেশটি আন্তর্জাতিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যেসব ছাড় উপভোগ করছে, সেগুলো থেকে বঞ্চিত হবে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী মহলের পক্ষ থেকে এ উত্তরণের রোডম্যাপ পিছিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে দোদুল্যমানতায় থাকার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী বছরেই উত্তরণটি ঘটবে।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে কিনা, তা নিরূপিত হয় বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও সূচকের দ্বারা। দেশের মানুষ রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান, বিশেষ করে শেখ হাসিনার আমলের পরিসংখ্যানের ওপর আদৌ বিশ্বাস রাখে না। এ সময় অর্থনীতি, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে যেসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই বানোয়াট এবং বিভ্রান্তিকর। সত্যিকার পরিসংখ্যানকে দুমড়ে-মুচড়ে নিজেদের ইচ্ছামাফিক প্রচারণার স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য হেন অপচেষ্টা নেই, যা আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের দুজন মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং মহীউদ্দীন খান আলমগীর অত্যন্ত নোংরা ভূমিকা পালন করেছেন। এ কারণে বিবিএসের মতো প্রতিষ্ঠানের ডেটা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাস্তব অবস্থা ছিল সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যানের বিপরীত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিবিএস দারিদ্র্যের ওপর একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের ২৭.৯৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ৯.৩৫ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)। বিশ্বব্যাংকও প্রক্ষেপণ থেকে জানিয়েছে, চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ১৫.৮ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী এবং অতিরিক্ত ৩ মিলিয়ন মানুষ এ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরগতি এবং দুর্বল শ্রমবাজার পরিস্থিতির কারণে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য শিশুদের ওপর আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলেছে। ২৮.৯ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে রয়েছে ২০২৫-এ। শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অধিকতর দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে।
শেখ হাসিনার আমলে দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হয়েছিল। ওই সরকার গণতন্ত্র নয় বরং উন্নয়নের ওপরই গুরুত্বারোপ করেছিল। তাদের ভাষায় এটা ছিল উন্নয়নের গণতন্ত্র। এতই যদি উন্নয়ন হয়ে থাকে, তাহলে সে সরকার বিদায় নেওয়ার এক বছরের মধ্যে দারিদ্র্যের এই হাল হলো কেন?
শেখ হাসিনার আমলে অনেক মেগা প্রকল্প ও আধামেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের কথা বলে প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল, সে প্রকল্প শেষ হয়েছে দেড়গুণ বা দুইগুণ অর্থ ব্যয় দিয়ে। এর একটি বড় কারণ হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা। বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে আওয়ামী আমলে ভারত, ইউরোপ ও চীনের তুলনায় প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে দেড় থেকে দুইগুণ অধিক অর্থ। কারণটি বোঝার জন্য রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। স্ফীত প্রকল্প ব্যয় ও বর্ধিত প্রকল্প ব্যয়ের অর্থের একটি বড় অংশ লুটেপুটে খেয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং অন্য স্বার্থবাদীরা। শেখ হাসিনার আমলে একটি পরিপোষণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। এ ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হয়েছে শেখ হাসিনার গোষ্ঠী-জ্ঞাতি ও আজ্ঞাবহরা। এ ব্যবস্থাকে অনেকেই আখ্যা দিয়েছেন crony capitalism. শেখ হাসিনার আমলে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, যেগুলো এখন শ্বেতহস্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এগুলো থেকে কোনো ধরনের বেনিফিট তো আসছেই না, বরং এগুলোর অবকাঠামো কোনোরকমে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারকে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। অনেক প্রকল্পই হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে কোনো ধরনের কস্ট-বেনিফিট এনালাইসিস না করে। প্রকল্পের যথার্থতা প্রমাণের জন্য যদি কোনো কস্ট-বেনিফিট এনালাইসিস করা হয়ে থাকে, তাও ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশ কোনোক্রমেই বিলাসিতা ও অপচয়কে প্রশ্রয় দিতে পারে না। অর্থনীতিবিদ পল এ. বারান বলেছিলেন, উন্নয়নশীল দেশে দুই ধরনের উদ্বৃত্ত থাকতে পারে, যা দিয়ে উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করা সম্ভব। এর একটি হলো বাস্তব উদ্বৃত্ত বা Actual surplus, অন্যটি হলো সম্ভাব্য উদ্বৃত্ত বা Potential surplus. এসব দেশের ধনিক-বণিক ও ভূস্বামীরা বিলাসব্যসনে যে অর্থ ব্যয় করে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যয় করতে গিয়ে যত রকমের অপচয় হয়, সেগুলো যদি ঠেকানো যায় এবং উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করা যায়, তাহলে অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া আরও জোরদার হবে। দেখা যাবে অপচয়কৃত অর্থ দিয়ে ভিন্ন একটি বা একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যায়। অগ্রাধিকার নির্ণয় যদি সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়, তাহলে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কাছে উন্নয়ন সুবিধা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু, এসব কথা শুনবে কারা? যাদের উদ্দেশ্য হলো জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের পকেট ভর্তি করা, তাদের কাছ থেকে সদাচরণ আশা করা যায় না।
যুগান্তরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের পারকী সমুদ্রসৈকতের পাশে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২ একর জায়গায় নির্মিত হয়েছে ‘রাজকীয় অতিথিশালা’। এ অতিথিশালাটি কর্ণফুলী টানেলের কাছে অবস্থিত। এতে রয়েছে ৩০টি ভিআইপি বাংলো, ৪৮ ইউনিটের মোটেল মেস, কনভেনশন সেন্টার, রিসোর্ট রিসেপশন ভবন, রেস্তোরাঁ, দোকান, জিম, অফিস, কনফারেন্স কক্ষ, জাদুঘর, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ নানা সুবিধা। নির্মাণের বছর পেরিয়ে গেলেও অতিথিশালাটি চালু হয়নি। অথচ প্রতি মাসে রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ সরকারকে গুনতে হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত শৈলজারঞ্জন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির একই অবস্থা। দুবছর আগে কেন্দ্রটির উদ্বোধন হয়েছে। এরপর থেকে কোনো সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয়নি। অথচ প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল গুনতে হচ্ছে ৪০ হাজার টাকা। স্টাফদের বেতনসহ অন্যান্য খাতে প্রতিমাসে লোকসান গুনতে হচ্ছে। অপরিকল্পিত এ প্রকল্পটিও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না, স্টাফ থাকা এবং বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা সত্ত্বেও কেন এ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি অব্যবহৃত পড়ে থাকবে। এ এলাকায় কি কোনো সভা-সেমিনার হয় না? হয় না কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা? হয় না কোনো ধর্মীয় আলোচনা বা বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ? মনে হচ্ছে থানা নির্বাহী অফিসারসহ কর্মকর্তারা এসব কাজে উৎসাহী নন বলেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
মেহেরপুরে ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ২৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল ভবন। ২০২৩ সালে প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হলেও কোনো কাজে আসছে না। পড়ে আছে অব্যবহৃত অবস্থায়। দেশে যে পরিমাণ মানুষ রোগে-শোকে ভোগে, সে দেশে কেন ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল ভবন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকবে? কোনোভাবেই এটা যানা যায় না। হাসপাতাল ভবনটি অব্যবহৃত থাকার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ না দেওয়া। হতে পারে হাসপাতালটিতে অতি প্রয়োজনীয় রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়নি। সুতরাং ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতাল ভবনটি নির্মাণ করার পরও কোনো কাজে লাগছে না সম্পূরক উপকরণের অভাবে। বাংলাদেশে সম্পূরক উপকরণের ব্যবস্থা না করে শুধু দালানকোঠা নির্মাণের নামে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বেফজুল অর্থ ব্যয়ের শামিল। মনে হয় এসব প্রকল্প নেওয়া হয় কারোর কারোর পকেট ভর্তি করার জন্য।
রেল উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান সাম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ফরিদপুরের ভাঙ্গা রেলস্টেশনটিকে শতকরা ১০০ ভাগ সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড রেলস্টেশন হিসাবে নির্মাণ করা হয়েছে। কেন এ বিলাসিতা? কেন এ মফস্বলের একটি রেলস্টেশনকে সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড করতে হবে, যেখানে খোদ রাজধানী ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে এমন কোনো সুবিধা নেই। আসলে বাংলাদেশের কোনো রেলস্টেশন এয়ারকন্ডিশন্ড হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। ড. ফাওজুল কবির আরও জানিয়েছেন, অনেক প্রকল্পের বাহুল্য ব্যয় তার সরকার কাটছাঁট করে রাষ্ট্রের অর্থ সাশ্রয় করেছে।
যুগান্তরের প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়েছে, জেলা-উপজেলায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এমন অনেক স্থাপনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৬ বছরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এসব ভবন। কখনো ব্যক্তিস্বার্থে আবার কখনো উন্নয়নের আড়ালে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে এসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে পকেট ভারী হয়েছে কতিপয় আমলা-রাজনীতিক-ঠিকাদার সিন্ডিকেটের। এ যেন পতিত আওয়ামী সরকারের ‘স্মার্ট দুর্নীতির’ অন্যতম অনুষঙ্গ। উন্নয়নের নামে মনগড়া এসব প্রকল্প এখন গলার কাঁটা হয়েছে। আমরা ভবিষ্যতের কোনো নির্বাচিত সরকারের আমলে এমন দুর্নীতি ও সম্পদের অপচয়ের নোংরা প্রদর্শনী দেখতে চাই না। যদি তারা এমন কিছু করে, তাহলে তাদেরকেও হাসিনার পথ ধরে চরম অসম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে হবে। জনতার আদালতের বিচার অত্যন্ত কঠিন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

