Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণগত পরীক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে সম্ভব

Icon

ড. মো. আসিরুল হক

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণগত পরীক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে সম্ভব

ফাইল ছবি

দেশের উচ্চশিক্ষার বৃহত্তম ক্ষেত্র হিসাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশাল দায়িত্ব পালন করে আসছে। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি মূলত দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোকে একাডেমিকভাবে সংযুক্ত করে একটি জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো গড়ে তুলেছে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক (অনার্স) ও স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পর্যায়ে অধ্যয়নরত আছে, যা একে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছে। প্রতিবছর কয়েক লাখ শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শিক্ষাদান পরিচালিত হয় কলেজ পর্যায়ে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক নীতিমালা নির্ধারণ ও চূড়ান্ত মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে।

এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে একটি একক কাঠামোর মধ্যে মূল্যায়নের দায়িত্ব পালন করা একাধারে যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনি এটি পরিকল্পিত ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করার পথে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধক। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন পদ্ধতি মূলত বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষাকেন্দ্রিক। এতে সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা কিংবা বাস্তব প্রয়োগযোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগ খুবই সীমিত। তার ওপর প্রশ্নপত্র প্রণয়নে পুনরাবৃত্তির প্রবণতা, মুখস্থনির্ভরতা, গাইডবইয়ের প্রভাব ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের গুণগত দুর্বলতা, এ সমস্যা আরও প্রকট করে তুলেছে।

এ সমস্যাগুলোর ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। ২০২৪ সালের বিআইডিএসের এক রিপোর্ট অনুসারে, অধিভুক্ত কলেজ থেকে পাস করা ২৮.২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার রয়েছে। এটি শুধু ব্যক্তিগত স্তরে নয়, জাতীয় অর্থনীতির জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হওয়া উচিত দক্ষ মানুষ তৈরি করা, কিন্তু বর্তমান পরীক্ষাব্যবস্থা এতে বাধা সৃষ্টি করছে। এ নিবন্ধে আমরা এ পরীক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো বিস্তারিত আলোচনা করব এবং সমাধানের উপায় প্রস্তাব করব।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষার মান নিয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে প্রশ্নপত্রের ধরন, প্রতি বিকল্প বছরে একই ধরনের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি এবং বাজারে সহজলভ্য গাইডবইয়ের ওপর ছাত্রছাত্রীদের অতি নির্ভরতা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার বাইরে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণী দক্ষতা গড়ে তুলতে পারছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যে চূড়ান্ত বার্ষিক পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, তা মূলত মুখস্থনির্ভর। এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি বা পাঠ্যবস্তুর গভীর বোঝাপড়ার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। একটি গবেষণা অনুসারে, অধিভুক্ত কলেজে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে আসে না। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশ্লেষণী ক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও মৌলিক চিন্তার দক্ষতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয় তাদের সমালোচনামূলক চিন্তা, গবেষণা দক্ষতা এবং মৌলিক ধারণা বোঝার ভিত্তিতে। সেখানে পরীক্ষার পাশাপাশি প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্ট ও গবেষণা প্রতিবেদন মূল্যায়নের অংশ হিসাবে ধরা হয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মূল্যায়ন (প্রতি পত্রে ৮০ নম্বরের পরীক্ষা) মূলত তিন ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে হয়-১ নম্বরের অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর, ৪ নম্বরের সংক্ষিপ্ত উত্তর এবং ১০ নম্বরের প্রবন্ধধর্মী উত্তর। এ প্রশ্নগুলোর ধরন বছরের পর বছর প্রায় একই রকমভাবে পুনরাবৃত্তি হয়। এ ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতির ফলে দেখা যাচ্ছে-একজন শিক্ষার্থী গাইডবই মুখস্থ করে ভালো ফল করছে, অথচ সে বিষয়ভিত্তিক ধারণা, বিশ্লেষণ, প্রয়োগ কিংবা গবেষণার যোগ্যতা অর্জন করছে না। এমনকি মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও মৌলিক চিন্তা, গবেষণাভিত্তিক লেখা কিংবা তথ্য বিশ্লেষণের মান অত্যন্ত দুর্বল।

কেন এমনটি ঘটছে? ১. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর প্রায় ৩৪-৩৫ লাখ শিক্ষার্থীকে পরিচালনা করে। এত বিশাল পরীক্ষার্থীর জন্য নতুন প্রশ্নপত্র তৈরি, মডারেশন, প্রিন্ট ও বিতরণ করা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তাই অনেকে সহজ সমাধান হিসাবে পূর্ববর্তী প্রশ্নপত্র পুনর্ব্যবহার করে। ২. শিখন কৌশল (Pedagogue) ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নে শিক্ষকদের সীমিত প্রশিক্ষণের কারণে অধিকাংশ শিক্ষকই পেডাগোজি ও দক্ষতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কার্যকর প্রশিক্ষণ পাননি। তাই তারা সঠিক জানেন না, শিখন কৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে স্তরভিত্তিক ও দক্ষতাভিত্তিক প্রশ্ন তৈরি করতে হয়। এর ফলস্বরূপ তারা প্রচলিত প্রশ্নের ধরন বজায় রাখেন। ৩. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিটি বিষয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন ও মডারেশনে সময়ের সীমাবদ্ধতা বেশি, ফলে পুরোনো প্রশ্নের পুনর্ব্যবহার একটি ‘সহজ পথ’ হয়ে দাঁড়ায়।

উন্নত বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে পরীক্ষাকেন্দ্রিক একমুখী মূল্যায়ন পদ্ধতির সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। যেমন-১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে যুক্তরাজ্যের কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় মুখস্থনির্ভরতা ও প্রশ্নপত্র পুনরাবৃত্তি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এর জবাবে যুক্তরাজ্য সরকার ‘Higher Education Quality Assurance’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বহুমাত্রিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করে, যেখানে প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্ট ও ওপেন বুক পরীক্ষা গুরুত্ব পায়। চীনের ওপেন ইউনিভার্সিটি এবং ইউকেভিত্তিক ওপেন ইউনিভার্সিটিতেও কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট, অনলাইন কুইজ, ভিডিও লেকচার পর্যালোচনা এবং প্রজেক্ট জমাদানের মতো বিকল্প মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা গুরুত্ব পায়। মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালায়াও ইউএসএম পরীক্ষার বাইরে ‘Capstone Project’ বাধ্যতামূলক করে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে। আমাদের উপমহাদেশে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি বিশ্বের বৃহত্তম ওপেন ইউনিভার্সিটি হিসাবে ৩৫ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী পরিচালনা করছে। তারা একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত ও বিকেন্দ্রীকৃত মূল্যায়ন কাঠামো অনুসরণ করে, যেখানে আঞ্চলিক কেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং প্রতি কোর্সের জন্য কন্টিনিউয়াস অ্যাসাইনমেন্ট বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া, তারা উত্তরপত্র মূল্যায়নে নির্দিষ্ট রুব্রিক্স ও প্রশিক্ষিত পরীক্ষক ব্যবহার করে। পাকিস্তানে হায়ার এডুকেশন কমিশন কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন অ্যাসেসমেন্ট, ওপেন বুক পরীক্ষা এবং গুগল ক্লাসরুমভিত্তিক টার্ম পেপার চালু করেছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে তারা একটি স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর মূল্যায়ন কাঠামো গড়ে তোলে, যার মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের মূল্যায়নের জন্য নির্দিষ্ট রুব্রিক্স ও গাইডলাইন থাকে। শ্রীলংকায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ‘Continuous Internal Assessment’ বাধ্যতামূলক করেছে। ব্যবহারিক বিষয়, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের ওপর ৫০ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ থাকে এবং বাকি ৫০ শতাংশ থাকে চূড়ান্ত পরীক্ষায়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং তাদের পরীক্ষাভীতিও অনেক কমে যায়।

এ অভিজ্ঞতাগুলো অনুকরণীয় হতে পারে, বিশেষ করে একটি বৃহৎ শিক্ষার্থীভিত্তিক ব্যবস্থায় যেখানে কেন্দ্রভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ কঠিন। বিকেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতা, প্রযুক্তিনির্ভরতা এবং মাননির্ভর মূল্যায়ন কাঠামো গড়ে তুললেই কেবল শিক্ষার গুণগত রূপান্তর সম্ভব।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা একটি সম্ভাব্য সমাধানের নির্দেশিকা এভাবে নির্ধারণ করতে পারি : ১. প্রশ্নপত্রের কাঠামো পরিবর্তন ও প্রশ্ন প্রণয়নে বৈচিত্র্য আনা; ২. মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার করা; ৩. প্রযুক্তিনির্ভর মূল্যায়নের চর্চা শুরু করা; ৪. প্রশ্নপত্র প্রস্তুত ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে গোপনীয়তা ও গুণগত মান নিশ্চিতকরণ; ৫. গাইডবইয়ের ব্যবহার সীমিতকরণ; ৬. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন; ৭. লাইব্রেরি ও রিসোর্স সেন্টার উন্নয়ন এবং ৮. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক একটি দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করা, যাতে শিক্ষার্থীদের ফল নির্ধারণে একটি বহুমাত্রিক ও সুষম পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান চূড়ান্ত পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার গুণগত মান অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক। শুধু পরীক্ষায় পাশ করাকে শিক্ষার উদ্দেশ্য মনে করলে সেই শিক্ষা কখনোই সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে না। মূল্যায়ন পদ্ধতিকে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, চিন্তা, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীলতা যাচাইয়ের একটি কার্যকর পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে প্রশ্নপত্রের ও মূল্যায়নের কাঠামোগত পরিবর্তন, প্রশ্নপত্রে বৈচিত্র্য, শিক্ষকের দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন একান্ত জরুরি। সময় এসেছে আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করার। শিক্ষার মূল লক্ষ্য যদি হয় মানবিক ও চিন্তাশীল নাগরিক গঠন, তবে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিও হতে হবে সেই লক্ষ্যবান্ধব।

ড. মো. আসিরুল হক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, এমসি কলেজ, সিলেট

asirul@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম