ভারতে মুসলিম কীভাবে মুজরিমে পরিণত হচ্ছে
ইসমাইল সালাহউদ্দিন
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভারতে এখন প্রতিটি সকাল শুরু হয় দুটি সমান্তরাল সংবাদ দিয়ে। একটি যা টেলিভিশনের পর্দায় সম্প্রচারিত হয়, তা অত্যন্ত যত্নসহকারে প্রস্তুতকৃত : পাকিস্তান নিয়ে প্যানেল বিতর্ক, হিন্দুত্বের গৌরব আর ‘নতুন ভারত’ নিয়ে সাজানো অবিরাম নাটক। আর অন্যটি, যা সম্প্রচারিত হয় না কিন্তু গভীরভাবে সত্য, তা হলো-মুসলিমদের প্রতিদিনের নির্যাতন, হয়রানি, জেলে পোরা আর দানব হিসাবে চিত্রিত করা। এ দুটির মধ্য দিয়ে যে বার্তাটি দেওয়া হয়, তা ভীষণ উদ্বেগজনক : মুসলিমদের দুর্ভোগের কথা হয় মুছে ফেলা হয়, নয়তো এটিকে তামাশায় পরিণত করা হয়, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে সন্ধ্যার বিনোদনের মতো উপভোগ্য; অন্যদিকে মুসলিমরা যেন বাধ্য হচ্ছে চিরস্থায়ী অপরাধীর মতো জীবনযাপন করতে, সব সময় অভিযুক্ত হতে; কিন্তু কখনোই তাদের কথা শোনা হয় না।
গেল সেপ্টেম্বরে আজমগড়ে সাত বছরের এক মুসলিম ছেলে হত্যার ঘটনাকেই সামনে আনা যাক। তার মরদেহ একটি ব্যাগে ভরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেশীরা তার মরদেহ দেখেও অদ্ভুতভাবে নির্বিকার ছিল, যদিও পরে তাদের গ্রেফতার করা হয়। কিছু সময়ের জন্য স্থানীয় প্রতিবেদনে খবরটি এসেছিল; কিন্তু দ্রুতই তা প্রাইম-টাইম টেলিভিশন থেকে উধাও হয়ে যায়। তার জায়গায় স্থান পায় লাভ জিহাদ, সীমান্ত উত্তেজনা কিংবা ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক। আসলে একজন মুসলিম শিশুর মৃত্যু জাতীয় ক্ষোভের চিত্রনাট্যে খাপ খায়নি। পরিবর্তে, এটি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া সহিংসতার নীরব মহাফেজখানার অংশ হয়ে যায়। সমাজবিজ্ঞানী স্ট্যানলি কোহেন একবার ‘অস্বীকারের অবস্থা’ (states of denial) নিয়ে লিখেছিলেন : এটি এমন এক সমাজ, যেখানে নৃশংসতা লুকিয়ে রাখা হয় না বরং এত নিয়মিতভাবে হজম করানো হয়, যেন তা কাউকে বিচলিত না করে। এখনকার ভারতে তাই দিনের আলোয় মুসলিম হত্যা ঘটে; কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এটিকে প্রেক্ষাপটের প্রতিধ্বনি (background noise) হিসাবে দেখে।
আবার যখন কানপুরের মুসলিমরা ‘আমি মুহাম্মদকে ভালোবাসি’ লেখা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছিল, পুলিশ তখন তাদের নিরাপত্তা না দিয়ে বরং ১,৩০০ মুসলিমের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে এবং গণগ্রেফতার শুরু করে। ভালোবাসার এ কাজটিকেই অপরাধ হিসাবে দেখানো হয়েছিল। অথচ যখন মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশে হিন্দুত্ববাদী জনতা একত্রিত হয়ে প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেয়, তখন টেলিভিশন কর্মীরা হয় তাদের মহিমান্বিত করে অথবা নীরবে চোখ ফিরিয়ে নেয়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একধরনের থিয়েটারে পরিণত হয়েছে, যেখানে মুসলিমরা সর্বদা কাঠগড়ায় থাকে আর হিন্দুত্ববাদী শক্তিরা সভ্যতার রক্ষকের ভূমিকায় থাকে।
যখন ইন্দোরে ‘জিহাদিমুক্ত বাজার’ গড়ার নামে মুসলিম ব্যবসায়ীদের রাতারাতি উচ্ছেদ করা হয়েছিল, তখনো দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম একে ‘আইনশৃঙ্খলার সমন্বয়’ হিসাবে তুলে ধরেছিল। কিন্তু এ উচ্ছেদের কারণে সেসব ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারের দুর্ভোগের দিকটি উল্লেখই করা হয়নি। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি উদযাপন করেছে, মুসলিমদের এ সম্পত্তি হারানোকে ভাইরাল বিনোদনে পরিণত করেছে। এটি দেশটির জন্য ন্যক্কারজনক ঘটনা হলেও সেটিকে নিত্যনৈমিত্তিক ‘স্থানীয় উত্তেজনা’ হিসাবে মোড়কজাত করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বরাবর এ তামাশার সংস্কৃতিকে মূর্ত করে তুলছেন। তার সরকারি মঞ্চ থেকে তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষ উগরে দিচ্ছেন, তাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদে সহানুভূতিশীল’ বলে আখ্যা দেন। অথচ তথাকথিত বিরোধী দলগুলো ক্ষোভ প্রকাশের পরিবর্তে কে বেশি ‘প্রো-হিন্দু’, সেটিই দেখানোর প্রতিযোগিতায় নামে। এ দলীয় ঐকমত্য স্পষ্ট করে দিয়েছে : মুসলিমরা ভারতে আর রাজনৈতিক বিষয় নয়; তারা রাজনৈতিক সহায়ক উপাদান মাত্র। পরিস্থিতি এখন এমন যে, দেশটিতে একজন মুসলিম হিসাবে বাঁচা মানে স্থায়ী সন্দেহভাজন হিসাবে থাকা-মসজিদে তারা থাকবেন নজরদারিতে, বাজারে বিচারের মুখে পড়বেন, শ্রেণিকক্ষে হয়ে থাকবে সন্দেহভাজন। বর্তমানে প্রতিটি জুমার নামাজ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। মুসলিমদের কাছে আজানের ধ্বনি হৃৎস্পন্দন হলেও কারও কারও কাছে উসকানি মনে হয়।
উগান্ডার বংশোদ্ভূত মুসলিম পণ্ডিত মাহমুদ মামদানির ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম’ ধারণাটি এ বাস্তবতাকে বুঝতে সাহায্য করে। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন কীভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ মুসলিমদের দুটি ভাগে বিভক্ত করে। একটি ভাগ ‘গ্রহণযোগ্য মুসলিম’, যারা নীরবে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। অপরপক্ষটি ‘বিপজ্জনক মুসলিম’, যারা প্রতিবাদ করেন, প্রতিরোধ করেন, এমনকি মর্যাদা দাবি করেন। ভারতে এ বিভাজনকে প্রতিদিন অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যে মুসলিম তার বিশ্বাসকে লুকিয়ে রাখে, যে আড়ালে থাকে, তাকে সহ্য করা হয়। কিন্তু যে মুসলিম প্রকাশ্যে ‘আমি মুহাম্মদকে ভালোবাসি’ বলে পরিচয় নিশ্চিত করে, সমান নাগরিক অধিকার চায়, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করে-তাকে সঙ্গে সঙ্গে মুজরিম, অর্থাৎ অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। মামদানি আমাদের মনে করিয়ে দেন, এটি ধর্মতত্ত্বের বিষয় নয়, এটি ক্ষমতার বিষয়।
এ কারণেই গণপিটুনির ভিডিওগুলো হোয়াটসঅ্যাপে মিমের মতো ছড়িয়ে পড়ে; এ কারণেই সংবাদ উপস্থাপকরা ‘মুসলিম জনসংখ্যা বিস্ফোরণ’ নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব প্রচার করার সময় মুখ টিপে হাসেন এবং এ কারণেই দোকান পুড়িয়ে দেওয়ার পর জনতা হাসে। ঘৃণা এখন কেবল আর রাজনীতি নয়; এটি সম্মিলিত বিনোদনে পরিণত হয়েছে। যখন নিষ্ঠুরতা কমেডি হয়ে দাঁড়ায়, যখন অপমান প্রাইম-টাইমের চিত্রনাট্য হয়, তখন গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মধ্যখানের রেখাটি ভেঙে পড়ে।
যে সমাজ সংখ্যালঘুদের দুর্ভোগকে বিনোদনে পরিণত করে, সেই সমাজ নিজেরাই এই পচন থেকে মুক্ত থাকে না। নাৎসি সমাবেশে জার্মান উদারপন্থিদের নীরবতা, কৃষ্ণাঙ্গদের গণপিটুনির সময় আমেরিকানদের নৈমিত্তিক উদাসীনতা এবং গাজায় বোমা হামলার সময় ইসরাইলি জনতার উল্লাস-এগুলো সবই মনে করিয়ে দেয়, ঘৃণার ওপর তৈরি বিনোদন শেষ পর্যন্ত সেই সমাজকেই গ্রাস করে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়।
যদি আজ আপনি মুসলিমকে মুজরিম (অপরাধী) হিসাবে শাস্তি দেওয়া দেখে করতালি দেন, তবে কাল আপনি জেগে উঠে দেখবেন, আপনি যে জাতির জন্য উল্লাস করেছিলেন, সেই জাতিই আপনার কারাগারে পরিণত হয়েছে এবং ততদিনে এ প্রজাতন্ত্রে ঘৃণার হাসিই হবে একমাত্র অবশিষ্ট শব্দ।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তরিত
ইসমাইল সালাহউদ্দিন : লেখক ও গবেষক, দিল্লি এবং কলকাতাভিত্তিক
