Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

প্রফেসর ইউনূস ভেবে দেখবেন কি

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রফেসর ইউনূস ভেবে দেখবেন কি

ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি

গত কিছুদিন ধরে কী সাংবাদিক, কী অধ্যাপক এবং কী বন্ধুবান্ধব, যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তারা জানতে চেয়েছেন, ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনটি হবে কিনা। তাদের এ উদ্বেগের কারণ আমি বুঝতে পারি। কারণ নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি মুখর ছিল বিএনপি। ২০২৪-এর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এত তাড়াহুড়া করে নির্বাচন দাবি করা সঠিক হয়েছিল কিনা, তা নিয়ে আমার চেনা-জানা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের কথা ছিল সরকারকে নিশ্বাস ফেলার সময় না দিয়ে নির্বাচন দাবি করা কতটা যৌক্তিক। এ বিষয়ের প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আমাকে জানান, আমরা একটি রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক দল হিসাবে আমরা তো নির্বাচন চাইবই। এরপর বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলে সরকার কোনো স্পষ্ট জবাব দেয়নি। একপর্যায়ে প্রফেসর ইউনূস জানালেন নির্বাচনটি ২০২৬-এর জুনে অনুষ্ঠিত হতে পারে, নির্বাচন আগেও অনুষ্ঠিত হতে পারে যদি সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যায়।

এ পর্যায়ে বিএনপি ২০২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানাতে থাকে। বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করার অভিযোগে প্রফেসর ইউনূস সরকারের সমালোচনা করতে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, সেসব সমালোচনা সাধারণ সৌজন্যবোধের সীমারেখা অতিক্রম করে যায়। এতে অনেকেই অসন্তুষ্ট হন। এদের মধ্যে ফরহাদ মজহার অন্যতম। তিনি প্রশ্ন তোলেন, নির্বাচন নির্বাচন করে বিএনপি দেশের জন্য কী ফায়দা আনতে চায়। যা হোক, এ পর্যায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, সরকারের সমালোচনা করে বিএনপির কী লাভ? বেগম খালেদা জিয়ার এ উক্তিতে দৃশ্যপট পালটে যায়। বিএনপি নেতারা সরকারের সমালোচনায় রাশ টেনে ধরেন। এরপর লন্ডনে প্রফেসর ইউনূস ও তারেক জিয়ার মধ্যে বৈঠক হলে ঘোষণা আসে, ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই মোতাবেক নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

লন্ডন বৈঠকে প্রফেসর ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা জামায়াত ও এনসিপির মনঃপুত হয়নি। তাদের বক্তব্য ছিল শুধু একটি দলের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের সময় ঘোষণা সঠিক হয়নি। এভাবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে নির্বাচনসহ নানা প্রশ্নে ঠান্ডা যুদ্ধ চলতে থাকে। অনেক দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে পিআর ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান, জুলাই সনদ প্রণয়ন এবং জুলাই সনদের আইনি কাভারেজ প্রদান। আমরা নাগরিকরা ভেবেছিলাম, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো ইস্যুতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থাকতে পারে এবং তা অসংগতও নয়। আশা করা গিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছে যাবে। দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু মতপার্থক্যের বিষয়ে সমাধান এলেও নতুন মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে। এসব কারণে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে। পরিস্থিতি একটু আশঙ্কাজনক হয়ে উঠলেই প্রফেসর ইউনূস বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে একটি সমাধানে আসার চেষ্টা করেন। এতে কিছু সুফলও অর্জিত হতে দেখা গেছে। তারপরও প্রশ্ন উঠছে, ঘোষিত সময়মতো নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দেশে ঘোষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। যদি নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন না হয়, তাহলে বিকল্প কী? একটি বিকল্প হতে পারে এক-এগারোর মতো সামরিক বাহিনীসমর্থিত একটি সরকার গঠন। কিন্তু শেখ হাসিনা আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠান সামরিক বাহিনীকে যেভাবে অবনমিত করেছেন এবং এর কিছু সদস্যকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে মানবতাবিরোধী অনেক অপরাধ সংঘটিত করিয়েছেন, তারপর সামরিক বাহিনীর পক্ষে দেশের এ জটিল মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। অবশ্য সামরিক বাহিনী এ ধরনের মর্যাদা ক্ষুণ্নের অবস্থায় পড়ে গেছে জেনারেল মঈনের হাত ধরে এক-এগারোর ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমরা চাই, জাতির সবচেয়ে মূল্যবান প্রতিষ্ঠান হিসাবে সামরিক বাহিনী তার পূর্ণমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক। সামরিক বাহিনী তার ক্ষুণ্ন হওয়া গৌরব ফিরে পাক।

এক-এগারো ধরনের সরকার ছাড়া অন্য কী বিকল্প আছে! অপর বিকল্পটি হলো, একটি জাতীয় সরকার গঠন। এমন ধরনের একটি সরকার গঠিত হতে পারত ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পরপর। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক সে সময় এটি হতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের যে অভাব ঘটেছে, তার ফলে কি এখন জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারে? আমার কাছে প্রতীয়মান হয়, দ্বন্দ্বমুখর সম্পর্ক নিয়ে এরূপ একটি সরকার কার্যকর হবে না।

অতি সম্প্রতি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া দীর্ঘ একটি পোস্টে বলেছেন, ইউনূস সরকার আরও এক থেকে দেড় বছর দায়িত্বে থাকতে পারে। তিনি বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের তীব্র সমালোচক। সেনাবাহিনীতে যারা পদস্খলিত হয়েছে, তাদের বিচার সঠিক হলেও সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা আত্মঘাতী কাজ। তবে তিনি যা বলেননি তা হলো, ইউনূস সরকার কীভাবে আরও এক থেকে দেড় বছর ক্ষমতায় থাকতে পারে। এ সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, আমলারা সরকারের প্রতি সহযোগিতা করছে না। অন্যদিকে পুলিশের আইজি বাহারুল সাহেব বলেছেন, তার বাহিনী এখনো অনেক ক্ষেত্রে নির্দেশ কার্যকর করছে না। এ অবস্থায় ইউনূস সরকারের পক্ষে নির্বিবাদে কতদিন দায়িত্ব অব্যাহত রাখা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কি তা অসংগত হবে?

খুব সাম্প্রতিককালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার নিয়েও স্পর্শকাতর প্রশ্ন উঠেছে। চিফ প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাজুল ইসলাম বলেছেন, এটাচ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব সামরিক কর্মকর্তাকে আইসিটিতে হাজির করতে হবে। তাদের কোথায় আটক রাখা হবে, তা নির্ধারণ করবে বিচারিক আদালত। অবশ্য ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, তাদের ক্যান্টনমেন্টের একটি ভবনে রাখা হবে। যাই হোক, বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনাকর পোস্ট-পালটা পোস্ট বের হচ্ছে। এসব পোস্ট প্রদানকারীদের মধ্যে অনেকে যেমন তাজুল ইসলামের অবস্থান সমর্থন করেছেন, আবার অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এতে সামরিক বাহিনীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে এবং সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়বে, যা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। যে কোনো বিচারেই মনে হয় আমরা একটি অত্যন্ত কঠিন সময়ের মুখোমুখি। এ সময়ে যদি জাতিরাষ্ট্রের হাল ঠিকভাবে ধরে রাখা না যায়, তাহলে জাতীয় অস্তিত্ব মহাবিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে।

শুরু করেছিলাম এই প্রশ্ন নিয়ে যে নির্ধারিত ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা। কিন্তু যে প্রশ্নটি অনেকেই তুলছেন না অথবা তুলতে জড়তাবোধ করছেন, সেটি হলো, দেশের কী হবে? অভিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার নিয়ে যখন মত-অমতের প্রসঙ্গ উঠছে, তখন তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড চিন্তাশীল মানুষদের প্রচণ্ডভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। এ অগ্নিকাণ্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং তজ্জনিত বিশাল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, রাজধানী মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের মৃত্যু এবং চট্টগ্রামে ইপিজেডে একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে পুরো কারখানাটি বিধ্বস্ত হওয়া। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরপর ঘটে। অভিযোগ আছে শাহজালাল বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ড থামাতে, বিমানবন্দরের নিজস্ব দমকল বাহিনীর ব্যবহার হয়নি এবং বাইরে থেকে আসা দমকলগুলোকে আটকে দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, এ অগ্নিকাণ্ডগুলো নাশকতা কিনা। নাশকতা হলে ভবিষ্যতে আরও এ ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নাশকতাকারীদের সম্ভাব্য টার্গেট মেট্রোরেল, কেপিআই ও বহুতল ভবন বলে মনে করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে সরকারকে আগাম কোনো সংকেত দিতে পারেনি। সব মিলিয়ে অভিযোগগুলোর মধ্যে কতটা সত্য নিহিত আছে, তার বিচারে প্রবেশ না করেও বলা যায়, আমরা এক জাতীয় বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এ বিপর্যয় থেকে কীভাবে মুক্ত থাকা যায়, তা নিয়ে সবার চিন্তাভাবনা করা উচিত। সীমান্তের ওপার থেকে শেখ হাসিনার অনুসারীরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার হুমকি দিচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানা গেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক নদী রক্ত দিয়েও আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারিনি। ৭ দফা গোপন চুক্তি, ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি, অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে ভারতের বৈরী আচরণ আমাদের স্বাধীনতাকে অরক্ষিত করে ফেলেছে। ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে সেই অরক্ষিত স্বাধীনতা উদ্ধারে বিপুল পরিমাণে রক্ত দিতে হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী শেখ হাসিনা এবং তার দলবল ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার জন্য একের পর এক পাঁয়তারা চালাচ্ছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর দলীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সামরিক বাহিনীকে এরা চরম ঘৃণা করত এবং এখনো করে। ক্ষমতায় এসে সামরিক বাহিনীকে দখলে নিতে গিয়ে বহুবিধ অন্যায় আচরণ করেছে, যার ফলে সামরিক বাহিনীর কাঠামোতে চিড় ধরেছে। তাই আজকের কর্তব্য হলো, সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ মহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। প্রয়োজন জুলাই অভ্যুত্থানের সহযোগী রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর ঐক্য। অধ্যাপক ইউনূস ভেবে দেখতে পারেন এ সংকট মুহূর্তে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তির একটি কনভেনশন আয়োজন করা যায় কিনা। যে কনভেনশন থেকে সমগ্র জাতিকে আহ্বান জানাতে হবে, যে কোনো মূল্যে ভারত ও তার দোসরদের আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমি রক্ষা করতে হবে। আহ্বান জানাতে হবে সমগ্র জাতি যেন আধিপত্যবাদীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। এ প্রেক্ষাপটে মনে করা যেতে পারে, ১৯৭৬-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়েছিল প্রতিরোধের ২১ হিসাবে।

ড. মাহ্বুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম