Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভূকৌশলগত পরিবর্তনের কেন্দ্রে মার্কিন নীতি

Icon

ড. সানিয়া ফয়সাল আল-হোসাইনি

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভূকৌশলগত পরিবর্তনের কেন্দ্রে মার্কিন নীতি

আমরা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা এবং বিশৃঙ্খলার একটি যুগে বাস করছি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান মেয়াদে ক্ষমতায় আসা এ অস্থিতিশীলতার প্রকট নিদর্শন। কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী আমেরিকান আধিপত্যের পর বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অবশ্য কয়েক বছর ধরেই এর আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। গত দশকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব হ্রাস, ওয়াশিংটনের ভূ-রাজনৈতিক শক্তি কমে যাওয়া এবং আঞ্চলিক সংঘাত বিস্তার লাভ করার ফলে বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য গভীরভাবে নড়বড়ে হয়ে গেছে।

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে অনেকাংশে পরিচালনাকারী বাস্তববাদীরা আমেরিকার বর্তমান পতনকে একটি উদ্বেগজনক লক্ষণ হিসাবে দেখছেন। কারণ, তাদের মতে এটিই ছিল বিশ্বব্যবস্থার মূল ভিত্তি। পরবর্তী যুগে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে রূপ প্রদানকারী স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী উদারবাদীরা যুক্তি দেন, ওয়াশিংটন একসময় যে উদার আধিপত্যবাদী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তা এখন দৃশ্যমানভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। ওয়াশিংটনে তাত্ত্বিকভাবে গৃহীত গঠনবাদীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বৈশ্বিক মূল্যবোধ ও নিয়ম উপেক্ষা করলে বিশ্বব্যবস্থা বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হতে পারে।

বর্তমান ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা আরও গভীর করতে ভূমিকা রাখছে। এ নীতি সচেতনভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উপেক্ষা করছে, বহুপক্ষীয় সহযোগিতার গুরুত্ব হ্রাস করছে, দীর্ঘ দশকের গড়া বৈশ্বিক মূল্যবোধ ও নিয়মের প্রতি উদাসীনতা দেখাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এ পরিবর্তন বোঝা অসম্ভব, যদি ট্রাম্পের ব্যক্তিত্ব, তার ব্যবসায়িক প্রবৃত্তি ও স্বার্থ এবং বড় আকারের অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বিবেচনা না করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, একজন নেতা যিনি জাতীয় স্বার্থকে তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক বিষয়ের সঙ্গে একীভূত করেন, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তার নীতির অনেক অসংগতি আরও বেশি বোধগম্য হয়।

ট্রাম্প ‘আমেরিকাকে আবারও মহান করো’ (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তবে তার প্রথম কাজগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিমা মিত্রদের কোণঠাসা করা এবং সেই অংশীদারত্বগুলোকে সঙ্কুচিত করা, যা দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার উদার ও সহযোগিতামূলক নেতৃত্ব দাঁড়িয়েছিল। এ মিত্ররাই দীর্ঘকাল ধরে আমেরিকার বৈশ্বিক নেতৃত্বের মেরুদণ্ড ছিল, যারা অভিন্ন আদর্শ এবং পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গভীর অংশীদারত্ব ও জোটের মাধ্যমে এটিকে একটি একমাত্রিক শক্তি হিসাবে বজায় রেখেছিল। একই সময়ে, ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে তার বাগাড়ম্বর বাড়িয়েছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাতের সুর চড়িয়েছেন। কিন্তু তার দেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় জোটগুলোকে শক্তিশালী করার বিষয়ে অবহেলা করেছেন। বিপরীতে, তিনি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট থেকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি গুটিয়ে নিয়েছেন।

ট্রাম্প বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে শতাধিক দেশের ওপর শুল্কারোপ করেছেন এ প্রচেষ্টায় যে, উৎপাদন ‘দেশে ফিরিয়ে আনা’ হবে। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি অভিবাসনবিরোধী নীতি জোরদার করেছেন, যা দেশটির শিল্প-শ্রমিক শ্রেণির জন্য ছিল খুবই ক্ষতিকর। বর্তমান যুগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিক শক্তি কমছে। ওয়াশিংটন তার ইউরোপীয় এবং এশীয় অংশীদারদের ওপর আর্থিক, নিরাপত্তা এবং সামরিক বোঝা চাপানো শুরু করেছে, যে ভূমিকা এটিকে একসময় একটি অপ্রতিরোধ্য বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত করেছিল, তা থেকে পিছিয়ে আসছে। ভারতের মতো আমেরিকার অনেক মিত্র, জাপান এবং ইউরোপীয় কয়েকটি রাষ্ট্র এখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, এমনকি নিরাপত্তা সহযোগিতা বজায় রাখছে, পাশাপাশি রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস কেনা অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক জোট কাঠামোকে পালটে দিয়েছে। ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু অংশ এখন নতুন সামরিক ও কৌশলগত বন্ধনে যুক্ত হচ্ছে। রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরান একত্রিত হচ্ছে-যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জন্য বড় কৌশলগত হুমকি। তুরস্ক, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সামরিক সক্ষমতা বাড়ছে; আর অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি এখন আরও বিস্তৃতভাবে এশিয়া, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে বিশ্ব অসম বহুমেরুয় ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রধান শক্তি হিসাবে থাকলেও রাশিয়া, ভারত, জার্মানির মতো মধ্যম শক্তির দেশগুলো ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে।

গাজার যুদ্ধবিরতি ইস্যুতেও ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। তিনি সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তিনির্ভর সম্পর্ক জোরদার করতে চান। কাতারে হামাস নেতাদের ইসরাইলের হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে দোহায় ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন; যা নজিরবিহীন ঘটনা। তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতি আনেন, ইসরাইলের দখল ও উচ্ছেদ পরিকল্পনা থামিয়ে দেন। এতে স্পষ্ট হয়ে গেছে, ইসরাইল এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল, সেটি ওয়াশিংটনের জন্য ক্রমে কৌশলগত বোঝা হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, মার্কিন রাজনীতিতেও অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটছে-ডেমোক্র্যাটদের বড় অংশ এখন ফিলিস্তিনের ন্যায়বিচার সমর্থন করছেন। এমনকি ইসরাইলকে দেওয়া সহায়তাও এখন বিতর্কের বিষয়।

বর্তমান মার্কিন নীতি অর্থনৈতিক স্বার্থ, অংশীদারত্ব ও স্থিতিশীলতা রক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে-যা শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের সেই উচ্চাভিলাষকে সীমিত করে দিতে পারে। এ মুহূর্ত হয়তো নতুন এক যুগের সূচনা, যেখানে ফিলিস্তিনে ন্যায় ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বৃহত্তর অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। উদীয়মান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ইসরাইল ক্রমশ একঘরে হচ্ছে এবং তার জবাবদিহিতা বাড়ছে। এ অঞ্চলের প্রতি বর্তমান মার্কিন নীতি, বিশেষত অর্থনৈতিক স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং স্থিতিশীলতা উন্নীত করতে ও খরচ কমাতে লক্ষ্যযুক্ত বিস্তৃত অংশীদারত্ব গঠনের ওপর জোর দেওয়া, শেষ পর্যন্ত সেই ইসরাইলি উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলোকে পুরোপুরি বাতিল করে দিতে পারে, যা অঞ্চলজুড়ে তাদের সম্ভাব্য প্রভাবকে সীমিত করবে। প্রশ্ন একটাই, আরবরা কি এ পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে এমন এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়তে পারবে, যা বাইরের শক্তির পরিকল্পনায় নয়, বরং তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিচয়ে গঠিত হবে-যে দৃষ্টি ও পরিচয় এতদিন অনুপস্থিত ছিল?

সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর

ড. সানিয়া ফয়সাল আল-হোসাইনি : অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স, আরব-আমেরিকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলিস্তিন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম