Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আ ফ ম মাহবুবুল হক : অসমাপ্ত জীবন

Icon

আনু মুহাম্মদ

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আ ফ ম মাহবুবুল হক : অসমাপ্ত জীবন

আ ফ ম মাহবুবুল হক। ফাইল ছবি

মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকে। সে সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী নেতা। পরিশ্রমী, সদালাপী এবং নিজ রাজনৈতিক অঙ্গীকারে দৃঢ় মানুষ হিসাবেই তাকে সবসময় পেয়েছি। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় ‘তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র ধারাবাহিক কাজের মধ্যে। বাংলাদেশের সীমিত গ্যাসসম্পদ রপ্তানির নানা আয়োজন এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী তেল-গ্যাস চুক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় কমিটি ১৯৯৮ থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আ ফ ম মাহবুবুল হক এ কর্মসূচিগুলোতে সর্বোচ্চ সক্রিয়তা নিয়ে অংশ নিয়েছেন। লংমার্চসহ শ্রমসাধ্য কর্মসূচিগুলোতে অনেকে কাহিল হয়ে গেলেও তাকে দেখেছি বরাবর উদ্দীপ্ত, সরব ও সক্রিয়। থেকেছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।

মাথায় প্রবল আঘাতের কারণে জীবনগতি ব্যাহত হওয়ার আগে পর্যন্ত শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন একই রকম উজ্জ্বল প্রতিভাদীপ্ত সক্রিয় দৃঢ় মানুষ। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মাহবুব ছাত্রজীবনে খুবই মেধাবী হিসাবে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় শীর্ষদের তালিকায় ছিলেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুলজীবন থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। পাকিস্তানে জাতিগত নিপীড়নবিরোধী লড়াইয়ে তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের সংগঠক। সেই ধারাতেই তার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি বিএলএফের রাজনৈতিক এবং গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম প্রশিক্ষক ও পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত যাত্রা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামাবলি গায়ে দিয়ে দেশ ও জনগণবিরোধী তৎপরতা অনেক বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ যারা পরিচালনা করেছেন, তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে রাজনৈতিকভাবে জনবিরোধী অবস্থান নিলেও মাহবুব ভাইয়ের অঙ্গীকারে কোনো ছেদ পড়েনি। তার রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীনতার পর আরও অগ্রসর করে নেওয়ার জন্যই নিবেদিত স্কুল। সেজন্য স্বাধীনতার পর দেশের শাসনব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি দেখে তিনি তার অংশীদার থাকেননি, নিয়েছেন বিদ্রোহী অবস্থান। প্রথমে জাসদ ও পরে বাসদের রাজনীতিতে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেন। বহু হামলা, মামলা, কারাবরণ মোকাবিলা করে তিনি রাজনীতি করেছেন। সমাজতন্ত্রী রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার তাগিদে তিনি সুস্থ থাকা পর্যন্ত অবিচল ছিলেন। তিনি শাসকশ্রেণির ভেতরে ঐক্য ও তাদের ভূমিকাকে যেভাবে সারসংক্ষেপ করে মানুষের সামনে উপস্থিত করতেন, তা খুবই জনপ্রিয় একটি কথনে পরিণত হয়েছিল। তিনি বলতেন, ‘ভিন্ন ভিন্ন নাম, একই কাম। ক্ষমতায় যাও, লুটেপুটে খাও।’

তিনি সারাজীবন যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন, আমরা সে রকম একটি সমাজেরই স্বপ্ন দেখি বলেই একসঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু সেই সমাজ থেকে বাংলাদেশ এখনো বহুদূরে; যেখানে মানুষ, মানুষ হিসাবে স্বীকৃত হবে, সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে সে জীবনে জীবন যোগ করবে; শিক্ষা, আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা ও বিশ্রামের অধিকার নিশ্চিত হবে সবার; শিশু পাবে তার শৈশব, বৃদ্ধ পাবে বার্ধক্যের অবসর; জাতি, লিঙ্গ, শ্রেণিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে, নিজেদের জীবন ও সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব দিয়ে, মানুষ একটি সমতা ও মর্যাদার সমাজ সৃজন করে বিশ্বে নতুন যাত্রায় যোগ দেবে; কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় লুটেরা দুর্বৃত্তসহ নানা শৃঙ্খল ও আধিপত্যের কারণে তার বিপরীত পরিস্থিতিই চলছে। এর থেকে মুক্তির লড়াই বহু বিস্তৃত।

বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গীভূত, বিশ্বায়িত; অনেক বেশি বাজারিকৃত। পুঁজির আধিপত্য অর্থাৎ মুনাফা ও বাজারকে লক্ষ্য করে উৎপাদনসহ নানা অর্থনৈতিক তৎপরতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ সময়কালে জাতীয় আয়, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। নগরায়ণ, জৌলুস, যোগাযোগ বেড়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য, বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতার ক্ষরণ চলছেই; সম্পদের কেন্দ্রীভবন, দখল, লুণ্ঠন, চোরাই টাকার দাপট শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতি সমাজকেও শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে এর বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াই শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত।

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতা, অসম বিকাশ এবং অন্তর্গত স্ববিরোধিতা এখন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়ন নামের সাম্রাজ্যবাদী এ ব্যবস্থায় পুঁজির অব্যাহত কেন্দ্রীভবন ও ঘনীভবন কতিপয় দৈত্যাকার বহুজাতিক সংস্থার হাতে বিশ্ব অর্থনীতিকে জিম্মি করে রেখেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উৎপাদনবহির্ভূত মূলধনী তৎপরতা। বর্তমান সময়ে ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট, তালিকাভুক্ত ও বহির্ভূতলগ্নিকারী সংস্থার ক্রমবর্ধমান তৎপরতায় মূলধন দ্রুত সংবর্ধিত হচ্ছে। এসব তৎপরতায় ফটকাবাজারি, প্রতারণা, কর ফাঁকি এবং বড় বড় বিধ্বংসী প্রকল্পে বিনিয়োগ অবিচ্ছেদ্য। এ ধরনের সংগঠিত তৎপরতায় মুনাফার হার অনেক বেশি। এসবের সঙ্গে অবধারিতভাবে যুক্ত যুদ্ধ আর ধ্বংস। বিশ্বজুড়ে বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবিদ্বেষও এ ব্যবস্থার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যেরই ফল।

পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত সংকট যত তীব্র হচ্ছে, তত তার সন্ত্রাসী চেহারাও নগ্ন হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন পুরোনো ঔপনিবেশিক কায়দা গ্রহণ করায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত বুর্জোয়া বিধিমালা পদদলিত করে তারা দেশে দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশ্বের এখন প্রধান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে বিশ্বের দেশে দেশে হিংস্র সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত আছে মার্কিন প্রশাসন। ভিয়েতনামসহ নানা দেশের পর গণতন্ত্রের নামে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ করে ইরাক, লিবিয়া আর আফগানিস্তানকে এখন ক্ষতবিক্ষত করছে। সর্বশেষ তাদের শ্যেনদৃষ্টি ভেনিজুয়েলার ওপর। টিকফা ছাড়াও এ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিক গোপন সামরিক চুক্তিও আছে। গত এক দশক ধরেই বাংলাদেশে মার্কিন সামরিক-বেসামরিক তৎপরতা বেড়েছে। বাংলাদেশে এ রকম বিশ্ব সন্ত্রাসী লুটেরা অপশক্তির অন্যতম সহযোগী উপসাম্রাজ্যবাদী ভারত ও দেশীয় লুটেরা শক্তি।

সাম্রাজ্যবাদী আঞ্চলিক কৌশলগত অবস্থানে ভারত এখন আঞ্চলিক কেন্দ্র। বৃহৎ রাষ্ট্র হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত পরাশক্তি। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা চুক্তি ও সমঝোতার কারণে ভারতের আধিপত্যবাদী চেহারা আরও আগ্রাসী হয়েছে। চীনও নানাভাবে আধিপত্য বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের ওপর রাহুর মতো ভর করে আছে দেশি লুটেরা গোষ্ঠীর সহযোগী হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও রাশিয়ার বাণিজ্যিক গোষ্ঠী। সরকার তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে গিয়ে এদের আধিপত্য মেনে নিচ্ছে। দুর্বল নির্ভরশীল অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক কর্তৃত্ব নিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর ঐক্য ও বিরোধ দুটোই বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

আ ফ ম মাহবুবুল হক বামপন্থি রাজনীতিতে পরিষ্কারভাবে সক্রিয় থেকেছেন বাংলাদেশে এ জনপ্রতিরোধ শক্তিশালী করতে। এ কাজে যে সাফল্য আসেনি, তার পেছনে অনেক কারণ; তার মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বামপন্থি নামে পরিচিত কিছু সংগঠন ও নেতার ভূমিকাও দায়ী। বামপন্থি বা সমাজতন্ত্রীদের মূল ভূমিকা হওয়ার কথা সব রকম বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্য থেকে মুক্ত একটি সমাজের জন্য লড়াই করা, লক্ষ্যে বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা। কিন্তু সেই বাংলাদেশে সামরিক শাসনসহ বিভিন্ন জটিল রাজনৈতিক পর্বে বামপন্থিদের বিভিন্ন নেতার বৃহৎ শাসক দলে যোগদান কিংবা বিভিন্ন মাত্রায় বৃহৎ পুঁজিপন্থি দলগুলোর কারও না কারও লেজুড়বৃত্তিক লাইন কেউ কেউ গ্রহণ করায় সমাজে বামপন্থি পরিচয়েরই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ধাপে দল ও আদর্শ ত্যাগ করায় এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে, তাদের তল্পিবাহকদের মধ্যে, সাবেক বামপন্থিদের সমাবেশ দেখা যায়, যাদের বিভিন্ন জনবিরোধী ক্রিয়াকলাপ সমাজে ‘বামপন্থি’দের কাজ হিসাবেই নিন্দিত। মাহবুবুল হক এ বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন।

মাহবুব ভাই তার জীবন সমাপ্ত হওয়ার আগেই দুর্বৃত্তদের আঘাতে গুরুতর জখম হয়ে নিজ কাজের জগৎ থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। তারপরও তিনি তার অঙ্গীকারাবদ্ধ কাজের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

আনু মুহাম্মদ : অর্থনীতিবিদ, লেখক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম