Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চীনের মহাকাশ অভিযাত্রা

Icon

খালিদ বিন আনিস

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চীনের মহাকাশ অভিযাত্রা

ছবি: সংগৃহীত

হাজার বছরের জ্যোতির্বিদ্যা থেকে শুরু করে আজকের চাঁদ-মঙ্গল অভিযানে চীন কেবল প্রযুক্তিগত নয়, কৌশলগতভাবেও মহাকাশে প্রভাব বিস্তার করছে। তাদের এ যাত্রা বৈজ্ঞানিক স্বপ্নের বাস্তবায়নের পাশাপাশি অন্যতম বিশ্বশক্তি হিসাবে রাজনীতিরও প্রতিফলন। একবিংশ শতকের ভূ-রাজনৈতিক ময়দানে যে নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, এখন তার সবচেয়ে স্পষ্ট মঞ্চ হলো পৃথিবীর কক্ষপথ, চাঁদ ও মঙ্গল।

প্রাচীন চীনের আকাশচিন্তা : চীনের আকাশমুখী কৌতূহল কোনো আধুনিক ধারণা নয়। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকেই চীনারা নক্ষত্রমণ্ডলের মানচিত্র অঙ্কন, চন্দ্রচক্র গণনা এবং সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস তৈরি করত। ঝৌ রাজবংশের আমলে (খ্রি.পূ. ১০৪৬-খ্রি.পূ. ২৫৬) জ্যোতির্বিজ্ঞান চীনের রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণের অংশ ছিল। এর প্রমাণ মেলে প্রাচীন বিজ্ঞানী ঝাং হেং-এর (Zhang Heng) উদ্ভাবনে। তিনি প্রথম যান্ত্রিক সিসমোস্কোপ আবিষ্কার করেন, যা ভূমিকম্প শনাক্ত করলেও তার নকশায় মহাবিশ্বের গতি ও বলবিজ্ঞানের ভাবনা ছিল স্পষ্ট। এ সময়েই চীনারা গানপাউডার ব্যবহার করে ‘ফায়ার অ্যারো’ বা অগ্নিবাণ তৈরি করে, যা আধুনিক রকেট প্রযুক্তির প্রাথমিক রূপ বলে ধরা হয়। এ প্রাচীন উদ্ভাবনই প্রমাণ করে, মহাকাশচিন্তার বীজ তারা বপন করেছিল বহু আগেই-যখন পশ্চিমা বিশ্বে রকেট চিন্তা কেবল কল্পনার স্তরে ছিল। চীনের আজকের মহাকাশ কর্মসূচি তাই কোনো আকস্মিক উদ্যোগ নয়, বরং হাজার বছরের ঐতিহ্যের আধুনিক বহিঃপ্রকাশ।

ঠান্ডাযুদ্ধের যুগে আধুনিক সূচনা : চীনের আধুনিক মহাকাশ অভিযান শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে। ১৯৫৬ সালে ড. ছিয়ান শুয়েসেন (Qian Xuesen) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে চীনা রকেট গবেষণার নেতৃত্ব দেন। তাকে ‘চীনের রকেটের জনক’ বলা হয়। তার হাতেই জন্ম নেয় চীনা মহাকাশ কর্মসূচি, যা পশ্চিমা শক্তিগুলোর সামরিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মুখে নিজেদের রক্ষা এবং জাতীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল। এর প্রথম বড় সাফল্য আসে ১৯৭০ সালে। সে বছর ‘ডং ফাং হং-১’ নামের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়ে চীন প্রমাণ করে দেয়, তারা প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্বশক্তিগুলোর পিছু পিছু নয়, বরং নিজস্ব গতিপথে এগোচ্ছে। এটি ছিল এশিয়া মহাদেশের প্রথম সফল স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ। এ সময় থেকেই শুরু হয় বিখ্যাত ‘লং মার্চ’ রকেট সিরিজ, যা আজও চীনের মহাকাশ অভিযানের প্রধান ভরকেন্দ্র এবং দেশের প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার প্রতীক।

চাঁদ থেকে মঙ্গলের পথে : চীনের মহাকাশ অভিযানের সবচেয়ে বড় মাইলফলকটি স্থাপিত হয় ২০০৩ সালে, যখন নভোচারী ইয়াং লিওয়ে ‘শেনঝো-৫’ মহাকাশযানে করে মহাকাশে পাড়ি দেন। এর মাধ্যমে চীন তৃতীয় দেশ হিসাবে (সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর) নিজস্বভাবে মানুষ পাঠানোর গৌরব অর্জন করে। এটি ছিল তাদের বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত সক্ষমতার এক চূড়ান্ত প্রদর্শনী। এরপর আসে চাং’ই প্রকল্প (Chang'e Program)-চীনের চন্দ্র অভিযানের ধারাবাহিক উদ্যোগ। এ প্রকল্পের অধীনে তারা ধারাবাহিকভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে :

* চাং’ই-৩ (২০১৩) : চাঁদে সফলভাবে ‘ইউটু’ (Yutu) রোভার অবতরণ।

* চাং’ই-৪ (২০১৯) : প্রথমবার চাঁদের অদৃশ্য পৃষ্ঠে (far side) সফলভাবে অবতরণ। এটি একটি জটিল প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ ছিল।

* চাং’ই-৫ (২০২০) : চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফেরার ৪৪ বছর পর প্রথম এমন কৃতিত্ব।

তবে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধু চাঁদেই থেমে থাকেনি। পরবর্তীকালে ২০২১ সালে তিয়ানওয়েন-১ মিশনের মাধ্যমে চীন মঙ্গলে সফলভাবে অবতরণ করে ঝুরং রোভার পাঠায়। ইতিহাসে এটি একমাত্র দেশ, যেটি প্রথম চেষ্টাতেই মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ, অবতরণ ও অনুসন্ধান-সবকিছুতে সফল হয়। এ অর্জন চীনের মহাকাশ প্রযুক্তির মানকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক নতুন উচ্চতায় স্থাপন করেছে।

মহাকাশে চীনের নিজস্ব প্রাসাদ : ২০১১ সালে শুরু হওয়া ‘তিয়ানগং’ (Heavenly Palace) প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন তৈরি। ২০২২ সালে সম্পূর্ণভাবে স্থাপিত তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশন এখন পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরছে, যেখানে চীনা নভোচারীরা নিয়মিত গবেষণা চালাচ্ছেন। যখন ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’ (ISS) ধীরে ধীরে তার অভিযানের শেষ পথে, তখন চীনের এ স্টেশন হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতে পৃথিবীর একমাত্র সক্রিয় কক্ষপথ গবেষণাকেন্দ্র। এটি চীনকে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে গবেষণার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেবে এবং মহাকাশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। নভোচারী চেন দোং-এর কথায় : ‘তিয়ানগং শুধু একটি মহাকাশ স্টেশন নয়, এটি চীনের আকাশমুখী আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।’

চীনের মহাকাশ কর্মসূচি কেবল বৈজ্ঞানিক নয়, এটি একটি কৌশলগত বিনিয়োগ। তাদের লক্ষ্য তিনটি প্রধান স্তরে :

* প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা : যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও চীন নিজস্ব রকেট, স্যাটেলাইট ও ন্যাভিগেশন সিস্টেম তৈরি করেছে, যা ভবিষ্যতে তাদের প্রযুক্তি সরবরাহ চেইনকে সুরক্ষিত রাখবে।

* অর্থনৈতিক শক্তি : ‘বেইদোউ’ ন্যাভিগেশন ব্যবস্থা এখন ১৬০টিরও বেশি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা জিপিএসের বিকল্প হিসাবে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে এবং চীনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে।

* আন্তর্জাতিক কূটনীতি : ‘Space Silk Road’ উদ্যোগের মাধ্যমে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহায়তা দিচ্ছে, যা তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে’র এক নতুন কসমিক সংস্করণ বলা যায়। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও দৃঢ় করছে।

চাঁদে ঘাঁটি থেকে মঙ্গলে উপনিবেশ : চীনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এখন আরও মহাকাব্যিক। তাদের লক্ষ্য পরিষ্কার-গভীর মহাকাশে নেতৃত্ব দেওয়া : চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি : ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর এবং রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘International Lunar Research Station’ স্থাপন। মঙ্গল অভিযানে অগ্রগতি : ‘তিয়ানওয়েন-৩’ মিশনে ২০২৮ সালে মঙ্গল থেকে মাটি ও পাথরের নমুনা আনার পরিকল্পনা। গভীর মহাকাশ গবেষণা : ২০৪৫ সালের মধ্যে জুপিটার ও অ্যাস্টেরয়েডে অভিযান চালানোর পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।

চীনের মহাকাশযাত্রা তাই শুধু বিজ্ঞানচর্চা নয়-এটি জাতীয় মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতীক। তারা চায় প্রযুক্তি ও মহাকাশের দৌড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে এবং মহাকাশে সামরিক ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রাধান্য নিশ্চিত করতে। সবচেয়ে বড় কথা, এটি ‘চীনা জাতির পুনর্জাগরণ’ বা ‘Chinese Dream’-এর বাস্তব রূপ।

এক নতুন আকাশযুগের সূচনা : প্রাচীন যুগে চীনারা আকাশের নক্ষত্র দেখে ভবিষ্যৎ গণনা করত। আজ তারা সেই আকাশেই নিজেদের উপস্থিতি লিখে রাখছে। হাজার বছরের ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মিশেলে চীন এখন মহাকাশে এক অপরিহার্য শক্তি। চীনের মহাকাশযাত্রা প্রমাণ করছে-এটি এক জাতির আত্মবিশ্বাস, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও ভবিষ্যতের ঘোষণা। মহাকাশ নিয়ে চীনের এ যাত্রা প্রমাণ করছে-‘আকাশ তাদের শেষসীমা নয়, বরং পরবর্তী গন্তব্য।’

খালিদ বিন আনিস : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম